আমার প্রথম স্কুলের নাম কিশোরী মোহন
পাঠশালা। আমার বড় ভাই বোন আগে থেকেই সে স্কুলে যাচ্ছে এবং এক সময়ে আমাকেও সেখানে
পাঠানো হয়। আমি একটু হাবাগোবা গোছের ছিলাম বলেই হয়তো সবাই ধরে নিল একা একা একটা ক্লাসে
আমি নিজে নিজে কুলিয়ে উঠতে পারব না। আমাকে তাই দেওয়া হল আমার বড় বোনের সাথে। বড়
বোন শেফু তার ছোট ভাইকে যক্ষের মত আগলে স্কুলে রওনা দিল। কোথায় বসব, কেমন করে বসব,
কি পড়ব, কি লিখব, কেমন করে লিখব, কিছু জিজ্ঞেস করলে কি বলব সবকিছু সে বলে দিল। ঘরে
বসে পড়াশোনা করে ততদিনে পড়তে শিখেছি ছোট খাটো অংকও করতে পারি। কিন্তু স্কুলের বিভীষিকাময়
ঘরে পা দেয়া মাত্র সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যায়।
স্কুলটি
মোটামুটি দীনহীন। বেঞ্চ খুব বেশি নেই, আগে না এলে বসার ভাল জায়গা পাওয়া যায় না।
গরিব কিছু ছেলেমেয়েকে অবশ্যি সব সময়েই মেঝেতে বসতে হয়। দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে
পা ছড়িয়ে বসে তারা ক্লাস করে, তারা যে বেঞ্চে বসতে পারে না সেটা নিয়ে নিজেদের খুব
আপত্তি আছে বলে মনে হয় না।
আমি
স্কুলে তটস্থ হয়ে থাকি। অন্য ছেলেরা ক্লাশের ফাঁকে হৈ চৈ করে ছুটোছুটি করে, পায়ে
সর্ষের তেল মেখে হা ডু ডু খেলে, আমি সেসবের মাঝে নেই, চুপচাপ ক্লাসে বসে উশখুশ করতে
থাকি কখন ছুটি হবে আর কখন বাসায় যাব। এর মাঝে আমি একদিন একটা ভয়ংকর ঘটনা দেখলাম।
আমাদের
স্কুলটিতে পাশাপাশি অনেকগুলি ক্লাস ছিল, মাঝখানে পার্টিশন নেই বলে সবাইকে এক সাথে দেখা
যায়। নিচু ক্লাস থেকে সব সময়ের দেখতে পাই উঁচু ক্লাসের ছেলেরা মাস্তানী করছে। একদিন
দেখলাম স্কুলের সবচেয়ে বড় মাস্তান ছেলেটি সব চেয়ে নিরীহ ছেলেটির নাক চেপে ধরল। আমি
তখনো শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিভাবে কাজ করে সেগুলি ভাল জানি না। বেঁচে থাকতে হলে নিঃশ্বাস
নিতে হয় আর নিঃশ্বাস নেবার জায়গা হচ্ছে নাক এইটুকু মাত্র শিখেছি। কাজেই কেউ যদি সেই
নাক চেপে ধরে তাহলে মানুষটা যে নিঃশ্বাস নিতে না পেরে মারা পড়বে সে ব্যাপারে আমার
এতটুকু সন্দেহ ছিল না। এই স্কুলের মাঝেই যে একজন আরেকজনকে মেরে ফেলছে ব্যাপারটা তখনো
আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, কিন্তু নিজের চোখে দেখছি ব্যাপারটা অবিশ্বাস করি কেমন করে?
আমার ইচ্ছে হলো ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠি, কিন্তু অনেক কষ্টে কান্না থামিয়ে রুদ্ধ-শ্বাসে
বসে রইলাম। মনে হচ্ছিল যে কোন মুহূর্তে ছেলেটা নিঃশ্বাস আটকে চোখ উল্টিয়ে দড়াম করে
নিচে পড়ে মরে যাবে। তখন পুলিশ আসবে, মিলিটারি আসবে, হৈ চৈ শুরু হবে, কে জানে আমাদের
সবাইকে হয়তো ধরে নিয়ে যাবে!
দীর্ঘ
সময় কেটে গেল, যার নাক চেপে ধরে রাখা আছে সে মারা যাবার কোন লক্ষণ দেখাল না, বরং হাসি
হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল এবং আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম নাক চেপে ধরে রাখলে কেউ
মারা যায় না। আমার সাদাসিধে মস্তিষ্কের জন্যে সেটি ছিল একটা যুগান্তকারী তথ্য।
কিশোরী মোহন পাঠশালার কাজকর্ম ছিল
খুব সরল। স্কুলের বেঞ্চে ছেলেমেয়েরা গাদাগাদি করে বসে থাকত। সামনে নড়বড়ে একটা চেয়ারে
পা তুলে বসে থাকতেন একজন মাস্টার। সেই মাস্টার খুব যত্ন করে কান চুলকাতে চুলকাতে মাঝে
মাঝে ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে একটা হুংকার দিতেন। পড়াশোনার ব্যাপারটা ছিল বাড়াবাড়ি
রকম সরল। মাস্টার মাঝে মাঝে হাই তুলতে তুলতে বলতেন, “অমুকটা পড়” কিংবা “অমুকটা কর”।
ছাত্রছাত্রীরা সেগুলি পড়ত না হয় করত। মাস্টার মাঝে মাঝে খাতা দেখতেন, মন মেজাজ খারাপ
থাকলে যারা ভুল করছে তাদের বেধড়ক পেটাতেন।
ক্লাসে
যখন আমাদের কিছু করতে দেওয়া হত আমি কখনোই কিছু বুঝতাম না। ফ্যাকাসে দিশেহারা চোখে
শেফুর দিকে তাকাতাম। শেফু আমাকে ফিস ফিস করে বলে দিত কি করতে হবে। আমি শুকনো মুখে দুরু
দুরু বুকে সেগুলি করতাম।
একদিন
ক্লাসে বসে আছি, স্যার হুংকার দিয়ে দুইটা অংক করতে দিলেন। বড় বড় যোগ অংক, করতে গিয়ে
আমার কাল ঘাম ছুটে গেল। যাদের যাদের করা হয়েছে তারা খাতা স্যারের টেবিলে রেখে এসেছে,
আমিও শেফুর পিছু পিছু খাতা জমা দিয়ে বসে আছি। স্যার ফার্স্ট বয়ের খাতাটা দেখলেন প্রথমে,
দুটো অংকই ঠিক হয়েছে। তখন তার উপর ভার দিলেন অন্যদের খাতা দেখে দিতে, সে মহা উৎসাহে
খাতা দেখতে লাগল। স্যার কান চুলকাতে চুলকাতে একটা বেত হাতে নিয়ে চেয়ারে পা তুলে বসলেন।
যাদের অংক ভুল হয় নি তারা খাতা ফেরৎ পেল। অন্যদের খাতা ফেরৎ নেবার আগে স্যারের সামনে
হাত পাততে হবে। যাদের একটা অংক ভুল হয়েছে তাদের হাতে শপাং শপাং করে দুইবার।
আমার
বোন শেফু তার খাতা পেয়ে গেছে, আমি পাই নি। তার মানে নিশ্চয়ই আমার অংক ভুল হয়েছে।
ভয়ে আতংকে আমার মুখ শুকিয়ে গেছে। শেফুর দুশ্চিন্তা আমার থেকেও বেশি। আমার কানে ফিস
ফিস করে বলল, “গিয়ে বলবি স্যার মাফ করে দেন। আর কোন দিন ভুল হবে না।”
এমনিই
কথা বলতে গেলে আমার তোতলামো এসে যায় আর এরকম অবস্থায় মুখ ফুটে কিছু একটা বলা তো মোটামুটি
অসম্ভব ব্যাপার। তবুও আমি মনে মনে কয়েকবার চেষ্টা করে প্রস্তুত হয়ে থাকলাম। আমার
বুক ধুক ধুক করছে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আর স্যার বেত দিয়ে মারছেন। বাচ্চাগুলি চিৎকার
করে হাত সরিয়ে নিচ্ছে কিন্তু কোন মুক্তি নেই। আবার হাত এগিয়ে দিতে হচ্ছে আর শপাং
করে হাতের উপর বেত নেমে আসছে। তার পর হাতটাকে বুকের মাঝে চেপে ধরে একেকজন চোখ মুছতে
মুছতে খাতা নিয়ে ফিরে আসছে।
ভয়াবহ
একটা বিভীষিকার মাঝে বসে আছি, বেঁচে আছি না মরে গেছি নিজেই টের পাচ্ছি না। এক সময়
শেফু আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “যা তোকে ডাকছে।”
আমি
কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম, “আমি?”
“হ্যাঁ।
যা। গিয়ে বলবি স্যার মাফ করে দেন। আর কোনদিন ভুল হবে না। মনে আছে তো?”
আমি
মাথা নাড়লাম, “মনে আছে।”
স্যার
খাতা দেখে বললেন, “দুইটা ভুল। হাত পাত।”
তাকে
দেখতে লাগল একটা রাক্ষসের মত, মনে হল আমার পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। ঢোক গিলে
শুকনো গলায় কোন মতে বললাম, “স্যার মাফ করে দেন।”
স্যার
আবার হুংকার দিয়ে বললেন, “হাত পাত।”
প্রচণ্ড
ধমকে আমি কেঁপে উঠলাম। কিছু বোঝার আগেই ভয়ে আমার হাত এগিয়ে গেল। ঠিক তখন আমার নিজের
উপর এত লজ্জা আর ঘেন্না হল যে বলার মত নয়। মনে হল আমি এত নীচ জঘন্য একটা প্ৰাণী আমি
বেঁচে আছি কেন? মানুষকে ধ্বংস করে দিতে হলে তাকে মনে হয় অপমান করতে হয়—সবার সামনে
করতে হয়।
আমি
স্যারের দিকে চোখ রেখে তার হাতে ধরে রাখা বেতের দিকে তাকিয়ে রইলাম আর সেটা শপাং করে
নিচে নেমে এল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় হাতের তালু থেকে একটা আগুনের হলকা যেন সারা শরীরের
মাঝে ছড়িয়ে পড়ল। আমি সেই অবস্থায় দাঁতে দাঁতে চেপে দাঁড়িয়ে রইলাম এবং তার মাঝে
দ্বিতীয়বার বেত নেমে এল, আমার মনে হল যন্ত্রণায় বুঝি আমি মরেই গেছি।
খাতা
নিয়ে আমি কাঁদতে কাঁদতে হাত মুঠি করে আমার সিটে ফিরে এসেছি। শেফু আমার হাতে হাত বুলাতে
বুলাতে বলল, “খুব ব্যথা করছে?”
আমি
মাথা নাড়লাম। শুধু ব্যথা নয়, তার সাথে সম্পূর্ণ নূতন একটা অনুভূতি যেটার সাথে আমি
পরিচিত নই। এই অনুভূতিটার নাম অপমান। আমার চার পাঁচ বছরের ছোট জীবনটিতে এর আগে কেউ
অপমান করে নি। আমার চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি ঝরছে, আর আমাকে দেখে শেফুর চোখেও পানি এসে
যাচ্ছে। আমার গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, “কাঁদিস না, এক্ষুণি ব্যথা কমে যাবে।”
খানিকক্ষণ
পর ব্যথার তীক্ষ্ণ যন্ত্রণাটা সত্যি কমে গেল, শুধুমাত্র যেখানে বেত এসে পড়েছে সেখানে
টকটকে লাল দুটি দাগ ফুলে আছে। আমি যতবার হাতের দিকে তাকাই ততবার চোখ থেকে ঝরঝর করে
পানি বের হয়ে আসে।
দুপুরবেলা
স্কুল ছুটি হওয়ার পর বাসায় ফিরে যাচ্ছি, শেফু বলল, “বাসায় গিয়ে যেন কাঁদিস না।
তাহলে সবাই জেনে যাবে।”
স্কুলে
অংক করতে না পেরে মার খেয়েছি ব্যাপারটার মাঝে যে একটা লজ্জা আছে, সেটা যে সবার কাছে
থেকে লুকিয়ে রাখতে হবে সেটা কেউ বলে না দিলেও আমি নিজেই বুঝে গেছি। আমি চোখ মুছে ফ্যাঁস
ফ্যাঁসে গলায় বললাম, “কিন্তু আমার তো খালি কান্না এসে যাচ্ছে।”
শেফু
খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “এই দ্যাখ—”
আমি
তার দিকে তাকালাম, সে তার নাক মুখ ভেংচে বিটকেলে একটা ভঙ্গী করে রেখেছে দেখেই আমি খিকখিক
করে হেসে ফেললাম। মাত্র কয়েকদিন হল সে নাক মুখ ভেংচে এরকম বিটকেলে মুখ তৈরি করা শিখেছে।
সেটা দেখলেই আমার হাসি পেয়ে যায় আর আমি খিক খিক করে হাসতে শুরু করি! শেফু নিশ্চিন্ত
ভঙ্গীতে বলল, “আর চিন্তা নেই। বাসায় গিয়ে যখনই তোর কান্না পাবে আমার দিকে তাকাবি।
আমি মুখটা এরকম করে রাখব—সাথে সাথে তোর হাসি উঠে যাবে!”
বুদ্ধিটা
আমার দারুণ পছন্দ হল, আমি আগেও দেখেছি সব ব্যাপারেই শেফুর বুদ্ধি আমার থেকে অনেক বেশি
সরেস।
বাসায়
ঢুকেই দেখা হলো মায়ের সাথে, সাথে সাথে আমার চোখ ভেঙ্গে পানি বের হয়ে আসার অবস্থা
হল। অবস্থা বেগতিক দেখে শেফু তার মুখ ভেংচে নেচে কুদে আমাকে হাসানোর চেষ্টা করতে শুরু
করে, কিন্তু কোন লাভ হয় না। আমি হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। সে কী কান্না! যত
দুঃখ কষ্ট লজ্জা অপমান সব যেন এই কান্না দিয়ে আমার মায়ের কাছে তুলে দেব।
সব
শুনে আমার মা আমাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন আর আবার আমার মনে হতে লাগল, যে
না—আমি লজ্জা পাওয়ার আর ঘেন্না পাওয়ার তুচ্ছ একটি মানুষ নই। আমার জীবনের একটা অৰ্থ
আছে।
রাত্রে
আমি আমার অংক খাতা নিয়ে বসেছি। যে অংক ভুল করে আমার জীবনের প্রথম বার মার খেয়েছি
সেই অংকগুলি ঠিক করে করব, অপমানের একটা গতি করব। প্রথম বার অংক দুটি করলাম আবার আগের
মতই ভুল উত্তর বের হল, আবার করলাম আবার ভুল। আরো কয়েকবার করলাম কিন্তু কিছুতেই ঠিক
করতে পারি না। প্রত্যেকবারই ভুল উত্তর বের হয়ে আসে। বাবা কাছে বসেছিলেন, অংক দুটি
দেখে বললেন, “তোর অংক তো ভুল হয় নি ঠিকই আছে।”
“ঠিক
আছে?”
“হ্যাঁ।”
আমার
তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, হাতে এখনো টকটকে লাল দাগ। আবার জিজ্ঞেস করলাম, “অংক ভুল হয়
নাই?”
বাবা
আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, “না বাবা, কোন ভুল হয় নাই। শুধু শুধু তোকে মেরেছে।”
আমার
জীবনের প্রথম পিটুনিটি আমি খেয়েছিলাম সম্পূর্ণ বিনা কারণে। কে জানে এর মাঝে আর কোন
অন্তনিহিত অর্থ লুকানো ছিল কী না!
0 মন্তব্য