কয়েক বছর আগের কথা।
ছেলে পড়িয়ে খাই, মোড়ের মাথায় চারজন লোক গরম হয়ে কথা বললে উল্টো পথে হাঁটি, .নিজে কখনও ভোট দিই নি আর সেই আমাকেই কিনা ভোট নিতে যেতে হল! আর এমন এক জায়গায় যার নাম শুনেই লোকে চমকে উঠে কেমন চুপ মেরে যেতে লাগল, আর আমার দিকে এমন করুণার চোখে তাকাতে লাগল যেন এই আমাকে শেষবারের মত দেখছে।
তবু বুকে সাহস আর সঙ্গে ছয় সঙ্গী, পঞ্চাশ রকমের জরুরি কাগজপত্র আর ফর্দ মিলিয়ে একাত্তরটি মালপত্ৰ—হ্যারিকেন থেকে ছুঁচ অবধি নিয়ে বাসে চাপলাম। বহুদূর চলার পর বালির ওপর ঘসটে চাকা টেনে বাস চলল, সবাই বললে নাকি নদী পেরোচ্ছি। এখন একটু শুকিয়ে গেছে এই যা। তারপর আরো বহুক্ষণ চলার পর নামা গেল দুনিয়ার আর এক প্রান্তে। সঙ্গে দুটি সেপাই ছিল, নেহাৎই নাবালক। ওরা নাকি ওদের জমি চষছিল। এমন সময় গবরমেন্টের লোক এসে লাঙ্গল কেড়ে পেয়ারাগাছের খেটে লাঠি ধরিয়ে দিয়ে জোর করে সেপাই করে দিয়েছে। ভোটের পর ছেড়ে দেবে।
সব গুনে গেঁথে, সেপাই দুটিকে ঘুম থেকে তুলে ফর্দ খুলে চৌকিদারের নাম খুঁজতে লাগলাম। এ সময় তার এখানে থাকার কথা। নাম ধরে কয়েকবার চেঁচালাম ‘পঞ্চু হালুই’ পঞ্চু হালুই করে। দূর থেকে কি একটা পাখি বারবার সাড়া দিয়ে গা পিত্তি জ্বালিয়ে দিলে। হাক ডাক শুনে সেক্টর আপিসের জীপ এসে আমাদের নিয়ে চলল। পঞ্চু হালুইয়ের পাত্তা মিলল না। অথচ ওর পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার কথা। সেক্টর অফিসার গজরাতে লাগলেন, ‘দাঁড়াও ব্যাটার চাকরি ঘোচাচ্ছি।’ গাড়ি আমাদের নিয়ে ত চলল, কিন্তু কোথায়? রাস্তা কই? এ তো উঁচুনিচু টিপি আর গাছের ঝোপঝাড় বিছিয়ে আছে চারদিকে। তবু চলল জীপ সেই সব মাড়িয়ে। বার চারেক উল্টোতে গিয়েও সোজা হল। আমাকে শূন্যে তুলে লুফতে লুফতে মাইল তিনেক মাঠ পেরিয়ে, বাশঝাঁড়ের মধ্যে একটা ডোবার মধ্যে পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়ে ইস্কুল বাড়িতে হাজির হল গাড়ি। এখানেই কাল ভোট নেওয়া হবে।
এই নাকি স্থানীয় ইস্কুল। গোটা আষ্টেক খুঁটির ওপর একটা খোড়ো চাল ঝুলে আছে কোনমতে। গোবর ল্যাপা নড়বড়ে মাটির দেওয়াল। ঝোড়ো হাওয়া বইলে কাল অবধি টিকবে কিনা সন্দেহ।
জীপ বিদায় নিল।
কোখেকে এগিয়ে এলেন এক পুলিশ সাবেইন্সপেক্টর। বললেন, আগেই আমরা এসে গেছি। ঐ ওধারে একটা ঘরে আছি। দেখলাম বেশ বড় ধরনের একটা পুলিশ দল। এই ধু ধু জনপ্রাণীহীন প্রান্তরে এত পুলিশ কেন রে বাবা! বেশ ঘাবড়ে গেলাম।
আসবাব বলতে দুটাে ভাঙ্গা চেয়ার, একটা তিন ঠাঙো টেবিল আর কয়েক সার লজগজে বেঞ্চি। ওগুলোতেই ভোট নেবার কাজ চালাতে হবে। এর মধ্যে জীপের আওয়াজ পেয়ে দুচারজন স্থানীয় মানুষ এসে হাজির।
এমন ভাবে তারা আমাদের দেখতে লাগল যেন মঙ্গলগ্রহ থেকে আসছি। আমাদের সেনবাবুর চশমাটা দেখিয়ে একটা ছেলে বুক ফুলিয়ে আর একজনকে জানাল যে তার কোন খুড়োও নাকি চোখে ও রকম পরে। তারপর বিস্ময় কমলে সেই ছেলেটিই, নাম বলল ভূতনাথ, মুড়ি আর জল নিয়ে এল। তারপর দেখি দুজন লোক একটা খাটিয়া ছেড়ে ঘুম থেকে উঠে হাই তুলে সামনে দাড়াল। তাদের একজন জামা তুলে পেটের তলা থেকে একটা পেতল আঁটা বেল্ট বার করে জামার ওপর পরে নিল। বুঝলাম এই চৌকিদার। বললাম, ‘কি গো, তোমার না থাকার কথা ছিল বড় রাস্তায়? অফিসার বাবু চটেছেন। তাতে ওর বিকার হল না। আরো রড় একটা হাই তুলে বলল, কি করব বাবু, গাড়ি গেলে ত। বাম দিকের গরুটি শিষ্ট। কিন্তুক ডেনদিকেরটি মাথা গরম করলে। তারপর ভূতনাথকে ধমকে বলল, “কি রে, আমরা একগাল মুড়িটুড়ি পাব না?’
খাটিয়ার অপরজন চুলটুল আঁচড়ে একটা ভাঙ্গা সাইকেল তুলে ছোট সেলাম দিয়ে বলল, ‘ক্রাসিন আনতে হবে ত বলুন, যাই! আমার নাম হারানিধি, লিস্টির সঙ্গে মিলিয়ে নিন।’ লিস্টে দেখলাম নাম রয়েছে, হারানিধি চৌবে, সাইকল মেসেনজার। বললাম, "এত তাড়া কিসের? একটু রোদ পড়ুক না। ও চমকে উঠে বলল, ‘আলো পড়ে এলে স্যার কোথাও যেতে পারব না, মাপ করবেন।' স্থানীয় একজন মুরুব্বি মত লোক মজা দেখছিল। বলল, ‘আলো পড়ে গেলে ঐ খালপারের মাঠ কেউ পেরোইনা আমরা। ওখানে ডাকাতির মহড়া হয়। দু পাঁচ টাকা আর তেল নুন সঙ্গে থাকলে ধড় থেকে মুণ্ডু নামিয়ে কেড়ে কুড়ে নেয়। মানুষ মারায় হাত পাকানোও হল, কিছু পাওয়াও গেল।’ আমি জায়গাটার দিকে তাকিয়ে একটা টোক গিললাম। আর আমার দলের সেপাই দুজন লাঠি হাতে আমার আড়ালে দাঁড়িয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল। এমন সময় সাব ইন্সপেক্টর সায়েব এগিয়ে এসে ইস্কুল ঘরের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পড়লেন।
চেয়ারটা একটা সন্দেহজনক শব্দ করল। তারপর, “কোনো ভয় নেই স্যার, আমি খোজ খবর নিয়ে এলাম, গণ্ডগোলের কোন চান্স নেই, বলে জাকিয়ে যেই হেলান দিয়েছেন আমনি সমস্ত জোড়টোড় খুলে চেয়ারটা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে গেল। স্থানীয় মুরুব্বিটা অমনি ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, 'এঃ হে হে, নিতাই সারের চেয়ার'—আকাশ থেকে ঠ্যাং নামিয়ে ধড়ফড় করে পুলিশ সায়েব উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ভাঙ্গা টুকরোগুলো লোকটির হাতে গুনে গুনে তুলে দিয়ে দাঁত কড়মড় করে বললেন, ‘নিতাই স্যারকে অ্যারেস্ট করা উচিত।"
তারপর কেরোসিন এল, হ্যারিকেন জ্বলল, কাগজপত্রের কাজ নিয়ে বসলাম। কাপড় টাঙ্গিয়ে গোপন ভোটকক্ষ তৈরি হল। পুলিশদের সঙ্গে মুরগীর ঝোলভাত খেয়ে, ব্যালট পেপারের বাণ্ডিল মাথায় দিয়ে ঘুম দিলাম। ঘরের একটা দরজাতেও খিল নেই। টেবিল বেঞ্চিগুলো দরজায় লাগিয়ে পুলিশদের সতর্ক থাকতে বলে তবু নিশ্চিন্ত হওয়া গেল না। খালি দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে চমকে উঠলাম—ঐ বুঝি কে দোর ঠেলে ছায়ার মত এগিয়ে এল, ঐ বুঝি আমার মুণ্ডুটা বা হাতে তুলে ডান হাতে ব্যালট পেপার ছিনতাই করল।
ভোর না হতেই, বাপরে বাপ, সে কি বিরাট লাইন ! কোথেকে সব মেয়ে পুরুষ, বুড়োবুড়ি সার সার গরুর গাড়ি বোঝাই হয়ে এসেছে। সবাই আগে ভোট দেবে! পুলিশরা একেবারে নাস্তানাবুদ হয়ে গেল ভিড় সামলাতে। সারাদিন ধরে চলল ভোট দেবার জন্যে কাড়াকড়ি। অতি উৎসাহী কেউ আবার টাটকা ভোটের কালি মাথায় মুছে কিংবা চেটেপুটে আঙ্গুল থেকে তুলে ফেলছিল। ধান্দা ছিল পরে ফের বেনামে আর একবার ভোট দেবার ফিকির খুঁজবে। তাদের ধরে ধরে ভাল করে কালি মাখানো হল। পুলিশ দিয়ে চোখ রাঙ্গিয়ে, জেল খাটাবার ভয় দেখিয়ে তবে কোনমতে নিরস্ত করা গেল।
কোথা দিয়ে যে দুপুর গড়িয়ে সাড়ে চারটে বেজে গেল টেরই পেলাম না। শুধু হাত পা গুলো অবশ হয়ে এল আর মাথাটা ঝিম ঝিম করতে লাগল। মাঝে মধ্যে একটু আধটু উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল বটে, বাইরে দাঁড়িয়ে দুপক্ষ মুখোমুখি আস্তিন গোটাচ্ছিল। তবে তা সামাল দিতে অসুবিধা হয়নি। একবার শুধু দুম করে কোথায় একটা পটকা ফাটল। দেখতে যাচ্ছি, ধাক্কা খেলাম সেই দুই সেপাইয়ের সঙ্গে। উর্ধশ্বাসে তারা ঘরে এসে ঢুকল। তাদের লাঠি দুটো কুড়িয়ে হাতে গুজে ধমকে ধামকে ফের বাইরে দাঁড় করিয়ে দিলাম। পুলিস লাগাতে হয় নি। শুধু জোড়হাতে অনুনয় করে বললাম, ‘দয়া করে নির্বিঘ্নে ভোট হতে দিন। হাঙ্গামা বাধালে মালপত্র তুলে মিয়ে বাক্স উল্টে ভোট বাতিল করে চলে যাব।’ এই কথাতেই কাজ হচ্ছিল খুব। দিমের শেষে হাঁপ ছাড়লাম। ভোটের বাক্স প্যাটরা গুনে, লোকজন নিয়ে জীপে উঠতে যাচ্ছি এমন সময় সাদা কাগজ হাতে সেই ভূতনাথ এসে হাজির৷ একগাল হেসে কাগজটা সামনে মেলে ধরে বলল, একটা সাটিফিট দিন স্যার। বললাম, কিসের সার্টিফিকেট?’ ঐ যে কত কাজ করলুম! মুড়ি জল এনে দিলুম, পুলিশদের জামাটুপি টাঙ্গাবার পেরেক হাতুড়ি—
অন্ধকার নামছিল। তাই আর কথা না বাড়িয়ে খসখস করে কোনরকমে কিছু প্রশংসা লিখে দিয়ে বললাম, ‘কি হবে এটা দিয়ে? ও বলল, ‘পঞ্চায়েৎ আফিসে চাকরি চাইব।
আমি বললাম, ‘ইস্কুলে পড় না?’ ভোটের ঘরটা দেখিয়ে ও বলল, ‘এই তো আমাদের ইস্কুল। চাকরি পেলেই পড়া ছেড়ে দোব।
আমাদের গাড়ি ফিরে চলল মাঠের ওপর দিয়ে দুলতে দুলতে।
0 coment�rios: