তিন জনের কাঁধে তিনটে চটের থলে। রফু আর মধুর বয়স দশ, পরণে কালো ছেড়া প্যান্ট, খালি গা, উচ্চতায় দু’জন সমান। নাদুর বয়স আট, তারও উদোম গা, পরণে দড়ি বাঁধা ডোরা প্যান্টালুন, কি যে তার রঙ ছিল বোঝবার উপায় নেই, ময়লা লেগে লেগে কালো হয়ে উঠেছে। মাথার কোঁকড়া চুল ঘাড় ছাপিয়ে গেছে। তেলের অভাবে চুল কটা!
রমনা থানার সামনে রাস্তার এপারে লন্ড্রিটার পেছনে দুটো ছাপড়া আড়াল হয়ে রয়েছে। সামনে থেকে চোখে পড়ে না বলে ছাপড়া দুটো টিকে আছে। না হয় কবেই পুলিশ ভেঙ্গে দিত। রফু আর নাজু পিঠোপিঠি ভাইবোন, মধু তাদের প্রতিবেশী বন্ধু।
রোজ সকালে তাদের মা-বাবারা বেরিয়ে গেলে তারাও থলে কাঁধে বেরিয়ে পড়ে। মগবাজার, ইস্কাটন ছাড়িয়ে তারা কখনো কখনো কাওরান বাজার পর্যন্ত যায়। এদিকে শাহবাগ, রমনা পার্ক, পাবলিক লাইব্রেরি, বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল সবই তাদের কাগজ কুড়োনর জায়গা। বেলিরোড ধরে শান্তিনগর, মালিবাগ, রাজারবাগেও তাদের যাতায়াত চলে। তিনজনে ক্ষিপ্ৰ হাতে কুড়িয়ে চলে যত পরিত্যক্ত কাগজ। তাদের এই ক্ষিপ্রতার কারণ কাগজ কুড়োনো ব্যাপারটার সঙ্গে শুধু যে তারা তিনজন আছে তা নয়, আরো অনেক ছেলেমেয়ে এই কাজে কাঁধে থলে ফেলে ঘুরে বেড়ায়। যে যত আগে কুড়োতে পারে তার লাভ। না হয় সারা দিনেও এক থলে পুরবে না। এই কাগজ জমিয়ে জমিয়ে একদিন তারা মৌলবী বাজারে দিয়ে আসবে মহাজনের কাছে। তারা মন দরে কিনে নেবে। এই সব টুকরো কাগজ যাবে নারায়ণগঞ্জ, কতলায় হার্ডবোর্ড-পিজবোর্ড তৈরির কারখানায়। রফু, মধু আর নাজু ঘুরতে ঘুরতে প্রায়ই সকালে একবার বেলি রোড ধরে অফিসার ক্লাবের দেয়ালের পাশে এসে দাঁড়ায়। সকালে ক্লাবঘরটা নিশ্চুপ। কেউ নেই। টেনিস খেলার মাঠ ফাঁকা। বিকেলে এই জায়গার চেহারা পাল্টে যায়। অনেক গাড়ি। অনেক লোকজন। গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরে খেলার মাঠে টেনিস বল নিয়ে ছুটোছুটি। তাই কখনও কখনও ওরা বিকেলে আসে খেলা দেখতে। সকালে খেলা না থাকলেও তারা আসে অন্য একটা আকর্ষণে। অনেক কাগজ পড়ে থাকে। সারা রাতের জঞ্জাল ঝাঁট দিয়ে ঝাড়ুদার ফেলে দিয়ে যায়। আর কোন পার্টি থাকলে খাবারের বাক্স কুড়িয়ে তারা চেটে চেটে খায়। সেদিন সকালে ওরা তিনজন অফিসার ক্লাবের দেয়ালের পাশে হাজির। বেশ কিছু কাগজ পড়ে আছে। চটপট হাত চালায় তিনজন। কাগজ শেষ। আজ কোন খাবারের বাক্স নেই যে তা নিয়ে চাটবে। না থাক। রোজ যে থাকবে এমন তারা আশা করে না। অনেক সময় দারোয়ান আর ঝাড়ুদার ঠোঙ্গা বা বাক্স নিয়ে চলে যায়। কিন্তু গতকাল রাতে যে খাওয়া-দাওয়া হয়েছে তার চিহ্ন পড়ে আছে, বাক্স নয়, একটা তাজা ফুলের তোড়া। রাতের শিশির মেখে ফুলগুলো সতেজ। নাজু ফুলের তোড়াটা কুড়িয়ে নেয়। তাকে ফুল কুড়াতে দেখে রফু বলে, ফেলাই দে, রাখনের কাম নাই।
না, রাখুম, সোন্দর ফুল, বলে নাজু।
হাতে ফুল রাখলে কাগজ টোকাবি ক্যামনে!
যখন কাগজ টোকামু ফুলগুলো মাটিতে রাখুম।
দরকার নাই ঝামেলায়। ফেলাই দে !
না, অমি রাখুম। নাজু জোর দিয়েই বলে। আমি বাড়িতে নিমু।
ফুল কি খাওনের জিনিস। কি লাভ নিয়া!
না, আমি বাড়িতে নিমু ! নাজু জিদ ধরে।
বড় ভাই হিসেবে রফু তার জোর খাটাতে চায়, না, বাড়িত নিয়া কাম মাই, ফেলাই দে।
না, বলে নাজু ফুলের তোড়াটা থলির মধ্যে ঢুকিযে ফেলে। রফু হঠাৎ খপ করে নাজুর থলিটা নিয়ে নেয় এবং ক্ষিপ্ৰ হাতে তোড়াটা বের করে নর্দমায় ফেলে দেয়।
নাজু অনেকক্ষণ একভাবে ফুলের তোড়াটার দিকে চেয়ে থাকে। তোড়াটা আস্তে আস্তে ময়লা পানির নিচে তলিয়ে যায়।
একটা কথা বললে না নাজু, সে থলিট কুড়িয়ে নিয়ে রমনা পার্কের দিকে হাটতে শুরু করে। আকাশে ঘন মেঘ। এই সময় বৃষ্টি নামে। রফু-মধু একটা ঝাঁকড়া জামগাছের নিচে আশ্রয় নেয়। এদিকে নাজু একমনে মাঝ রাস্তা দিয়ে চলেছে। বৃষ্টির ধারা গড়িয়ে চলে তার কটা চুলের জট ধরে।
রফু চীৎকার করে ডাকে, এই নাজু পানিতে ভিজিস না ...
দু দিন আগে তর জ্বর ছিল ...
নাজুর কোন ভাবান্তর নেই। তুমুল বৃষ্টির মধ্য দিয়ে আবছা একটা ছায়ামূর্তির মত সে ধীর পায়ে এগিয়ে চলে।
আমি তরে ফুল পাইড়া দিমু, নাজু শোন... জোর গলায় ডাক দেয় মধু। বৃষ্টির শব্দে তার ডাক খানিক দূর গিয়ে মিশে যায়।
ভিজলে ভিজ, তরই জ্বর হইব... মরবি ... গজ গজ করে রফু। বড় মেঘটা এক নাগাড়ে আধঘন্টা বৃষ্টি ঝরিয়ে সরে গেলে রফু-মধু গাছতলা থেকে বেরিয়ে রমনা পার্কের দিকে এগিয়ে চলে। বৃষ্টিতে ছেড়া কাগজ সব ভিজে গেছে। এখন আর কাজ হবে না। তারা পার্কে ঢুকে একটা বেঞ্চিতে বসে বলাবলি করে, নাজুটা যে কোথায় গেল।
মধুবলে, ফুলের তোড়াটা নিলে কি হইত?
ফুল নিয়া লাভ কি?
লাভ নাই, তবে অর ভালো লাগছে ...
ফুল বড় মাইনষের জিনিষ। তারা গাছ লাগায়, ফুল কাটে, ফুল ফ্যালায়া দায় . আমাগো ফুলের কোন কাম নাই…
নাজু বাচ্চা মানুষ ত…
রফু আর কোন কথা বলে না।
বেলা বাড়লে তারা পার্ক থেকে বেরিয়ে শাহাবাগের দিকে এগোয়। সঙ্গে নাজু নেই বলে তাদের কিছুটা খারাপ লাগে।
পিজি হাসপাতালের সামনে বা দোকানের সামনে তেমন কাগজ পড়ে থাকতে দেখল না।
হাঁটতে হাঁটতে তারা কাঁটাবন ফেলে প্রায় এলিফেন্ট রোড পর্যন্ত হাজির।
একটা ডাস্টবিনে বেশ কিছু কাগজ পড়ে থাকতে দেখে দুজন ঝুঁকে পড়ে। ওপরের ভিজে কাগজ সরিয়ে তারা ফটাফট ঝুলিতে কাগজ পুরতে থাকে। এখন রফু আর মধুকে দুই বন্ধু বলে মনে হয় না। কেউ কাউকে যেন চেনে না। চোখে মুখে একটা অস্বাভাবিক ব্যগ্রতা। ক্ষুধার্ত কুকুর যেমন গ্রাস তুলতে থাকে, মুখ চোখ হিংস্র হয়ে ওঠে, তেমনি দুজনের মুখে হিংস্রতা, লোভ। মুখে ঘাম জমতে থাকে।
কাগজ খুব বেশি ছিল না। অল্পক্ষণেই শেষ। চুপসে থাকা থলির নিচের দিক কিছুটা ফুলে ওঠে।
আরো কিছুটা এদিক ওদিক ঘুরে কোন কাগজ না পেয়ে তারা ফিরে চলে। বৃষ্টির পর চড়া রোদ। পেটে ক্ষিধেটাও চাড়া দিয়ে উঠেছে। পেট মোচড় দিচ্ছে।
ঝুপড়িতে ফিরে রফু দেখে নাজু শুয়ে। গায়ে একটা ছালা চাপান। তার মা রান্নার ধোয়ায় ঝুপড়ি ভরিয়ে ফেলেছে।
মা, নাজু শোয়া ক্যান?
জ্বর।
কইলাম পানিত ভিজিস না। আমার কথা হুনল না।
বিকেলে রফু থলিটা ঝুলিয়ে আবার বেরতে যাবে, তার মা তাকে বাইরে যেতে নিষেধ করে। নাজুর কাছে বসতে বলে।
তার মা ছুটা কাজ সারতে যায়। আসবে সেই রাত ন’টায়। খাবার নিয়ে এলে ভাগ করে খাবে।
আটটার দিকে রফুর বাপ হাজির। মাঝ বয়সি লোক, শীর্ণ চেহারা। মুখে কাঁচা পাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, খালি গা, পরণে ময়লা লুঙ্গি, কোমরে গামছা জড়ান।
বাপকে দেখে নাজু কান্না জুড়ে দেয়।
জ্বর বেড়েছে তার। কিছু খায়নি, ক্ষিধেও লাগছে।
আমারে কমলা আইনা দাও - বায়না ধরে নাজু।
অখন বরষা কাল কমলা কই পামু, জবাব দেয় নাজুর বাপ।
আমি দেখছি, নিউ মার্কেটে পাওয়া যায়। আমারে কমলা আইনা দাও...
কমলা কেননের কি টাকা আছেরে মা ...
আমি কিছু চাইলেই খালি তোমার টাকা থাকে না...
আমরা গরীব মানুষ, কমলা খাওনের কপাল করি নাইরে মা …
নাজুর বাপ নিজেকেও এই প্রশ্ন করেছে অনেক বার, কোন জবাব পায়নি। জীবনে তেমন কোন পাপ করেনি। গ্রামে তবু একটা ভিটে ছিল, তাও গেল মহাজনের হাতে দেনা শোধ না হওয়ায়।
কমলা কমলা করে ঘ্যান ঘ্যান করতে করতে নাজু ঘুমিয়ে পডে।
রফু ভাবে সে কাগজের টাকায় নাজুকে কমলা কিনে দেবে। কিন্তু একটা কমলার দাম তিন টাকা ... তাকে আরো অনেক কাগজ জমাতে হবে। কাল সকাল সকাল বেরবে কাগজ কুড়োতে।
সকালে নাজুর বাপ চলে গেল ঠেলাগাড়ি নিয়ে।
মধু ডাক দেয়, রফু বাইর হবি…
আসি... রফু জবাব দেয়।
এই সময় আবার কাঁপন দিয়ে জ্বর আসে নাজুর।
রফুর আর বাইরে যাওয়া হয় না। মা আর ছেলে নাজুর মাথায় পানি ঢালায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ঘন্টখানেক পর জ্বর একটু কমলে রফুর মা যে বড়িতে ছুটা কাজ করে তাদের কাছে ছুটি নেবে বলে বেরিয়ে পড়ে। রফুকে বোনের কাছে থাকতে হয়।
খানিক পর নাজুর মা ফিরে দেখে নাজু একা। রফু নেই। মা খুব রেগে যায় অসুস্থ ছোট বোনটাকে ফেলে যাওয়া! আসুক দেখাবে।
দু মিনিটও যায়নি, রফু হাজির।
মা কিছু বলার আগেই সে নাজুর কাছে এগিয়ে যায়।
নাজু আস্তে আস্তে চোখ মেলে। দেখে রফু একটা ফুলের তোড়া সামনে বাড়িয়ে রেখেছে।
নাজু হাত বাড়িয়ে তোড়াটা নিয়ে দেখে। তারপর মাথার কাছে রেখে দেয়। সে কতটা খুশী হয়েছে ঠিক বোঝা গেল না, কিন্তু রফুর দু চোখ তখন তৃপ্তিতে চিকচিক করছে।
গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।
0 coment�rios: