সেই যে ভালুক দুটো। দুই ভাই। একজন হোৎকা মুখো। আরেকজন ভোৎকামুখো। কেমন করে হাঁটে বল তো?
একজন হাঁটে হোদুল-দোদুল-নোদুল-নোদুল।
আরেকজন হাঁটে হুম-হা। গুম-হা।
একজনের পায়ে ঘুঙুর। আরেকজনের গলায় ঘণ্টা। যখন দুজন গলা ধরাধরি করে হাটে, তখন শব্দ হয় ঝুমুর-ঝুম টুং-টাং ৷
ছোট ভালুক বড় ভাই। তার নাম হুকু। বড় ভালুক ছোট ভাই। তার নাম ভুকু। দুজনের মধ্যে যা ভাব না— । হুকু লাল জামা পরলে ভুকু সবুজ প্যান্ট পরে। হুকু নীল টুপি পরলে ভুকু হলদে মোজা পরে। দুজনে হাত ধরাধরি করে গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যায়। আর গাছতলায় বসে আইচ্কিরিম কিনে খায়।
একদিন হুকু আর ভুকু—কী যেন—কী—কেন—চাকরি বাকরি ছেড়ে ছুড়ে-ওমা—একেবারে দেশে চলে গেল। কেন? দেশে কী?
দেশে পাতার ছাউনির দুটো ঘর—হাত দেড়েক উঁচু। সেই ঘরদুটোতে কষ্টমষ্ট করে ওরা দুজন ঘুমুতো। চারপাশে গাছ। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড। আম গাছ। জাম গাছ। মহুয়া গাছ। গাছে গাছে মৌচাক, ইয়া বড় বড়। দুজন ঘুম থেকে উঠে প্রথমে একটা হাই তুলত বিরাট হা করে। আর তুড়ি বাজাত তিনবার। কুৎ-ঠুকুৎ-ঠুকুৎ। তারপর খেত আম জাম মহুয়া মধু, ছাগলের দুধ, জল, শেষে একটা কাঠি। খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে হুকু ভুকু কী করে?
“কী করা যায় বল তো?”
“আচ্ছা ঢোলটা বাজানো যাক।” বলেই হুকু ঢোলটা বের করে বাজাতে শুরু করে, ডিডিম ডিম ডিডিম ডিম্।
“আচ্ছা তাহলে নাচা যাক।” বলেই ভুকু নাচতে শুরু করে—হুলা হুলা হুলু হুলা।
তারপর একসময় ভুকু ঢোল বাজাতে বসে, আর হুকু নাচতে শুরু করে। বেশ ভালো, দিনগুলো কাটছিল মন্দ না।
কিন্তু একদিন কী যেন কী— কেন— কী—হুকুর হাতে একটা কোদাল। ভুকুকে বলল, “তুইও একটা কোদাল নে৷”
“কেন?”
“চল, মাটিটা খুঁড়তে খুঁড়তে খুঁড়তে খুঁড়তে পৃথিবীর ওপারে চলে যাই।”
“চল”
দুটো কোদাল হাতে নিয়ে হুকু ভুকু হোদুল দোদুল হুমহা গুমহা করতে করতে এলো মাঠের ওপর। কোপ বসাতে লাগল ধপাধপ ধপাধপ।
খুঁড়তে খুঁড়তে এত্তো এত্তো মাটি বেরুল। আরও বেরুল। আরও।
খালি মাটিই বেরুচ্ছে। শেষে একখানা টোপর সোনার তৈরি। মাত্র একখানা। “ওমা একখানা যে। আরেকখানা হলে না হয় .. ”
তখন ওরা আরও খুড়ল। কিন্তু খোডাখুড়ি করেও সোনার টোপর দুখানা হল না।
এখন সোনার টোপরটা মাথায় দেবে কে? হুকু? না ভুকু? দুজনেরই মাথায় হাত গালে হাত।
হুকু বলল, “ টোপর আমারই হওয়া উচিত।”
ভুকু বলল, “উহু ওটা আমারই হওয়া উচিত ”
“শুধু শুধু তোর হবে কেন শুনি?"
“শুধু শুধু তোরই বা কেন হবে?”
বড় ভালুক ছোট ভাই-এর এমনতর গো দেখে ছোট ভালুক বড় ভাই হুকু খুউব রাগ করল। বলল, “আমি না তোর দাদা, গুরুজন?”
তখন বড় ভালুক ভুকু মুখটুক গালটাল ফলিয়ে বলল, “আমিও তো তোর ছোট্ট ভাইটি আদুরে।”
বাস কী ঝগড়া বেঁধে গেল দুজনের মধ্যে। সে-ঝগড়া কিছুতেই থামে না!
“হুম হা গুম-হা—এ টোপর আমার।”
“হোদুল দোদুল নোদুল নোদুল –এ টোপর আমার।”
“হুম-হা গুম-হা—এ টোপর আমার।”
“হুম-হা ...আমার।”
“নোদুল নোদুল ... আমার।”
তখন পাড়াপড়শী খরগোশ, কাঠবেড়ালী, মোরগ, নেকড়ে, হাঁস-টাস, জিরাফ-টিরাফ—সব এসে পড়ল। বলল, “কী হল তোমাদের? ঝগড়া করছ কেন? তোমাদের কি খিদে পায় না?”
“হ্যাঁ পায়।” হুকু বলল।
“পায় তো।” ভুকু বলল। বলেই ঝুমুর ঝুম টুংটং করতে করতে ঘরে ঢুকল। তারপর মধু মেখে আমের আচার খেতে বসল। ফুরিয়ে গেলে আতা খেল। ফুরিয়ে গেলে মধু খেল। ফুরিয়ে গেলে খেজুরের গুড় খেল। ফুরিয়ে গেলে জল খেল। হেউ করে একটা ঢেকুর তুলে, কাঠি চিবুতে চিবুতে ঘুমিয়ে পড়ল। নাক ডাকল, ঘোর-ঘোর-ঘোরাৎ।
যাক বাবা, পাড়াপড়শীরা ভাবল, ঝগড়াটা তাহলে খতম।
তারপর ঘুম ভাঙলে দুই ভাই হাত পা ছুড়ে, মস্ত হা করে, হাই তুলল। ঠকাৎ-ঠকাৎ—তুড়ি বাজাতে বাজাতে হুকু এদিক তাকাল, সেদিক তাকাল। চোখ পড়ল সোনার টোপরটার দিকে .
“এ সোনার টোপর আমার।”
“না, আমার।”
“বলছি আমার।”
আবার ঝগড়া বেধে গেল। ভীষণ ঝগড়া। পাড়াপড়শী খরগোশ-টরগোশ সবাই যার-যার দরজায় খিল এটে কানে আঙুল দিয়ে বসে রইল। কী কাণ্ড! ছিলি ভালো আমজাম মধু খেয়ে, ঢোল বাজিয়ে, নেচে, নাক ডাকিয়ে—কোথা থেকে কী না কোথা থেকে কী “মাটি খুঁড়তে শুরু করে দিলি। তা মাটি না হয় খুঁড়লি ... তায় সোনার টোপর পেয়ে গেলি। তাও একখানা। তা সোনার টোপর না হয় পেলি, একখানা পেলি, ...তা বলে তা-ই নিয়ে ঝগড়া?
হাঁস-টাস জিরাফ-টিরাফ সব গালে হাত দিয়ে বসে রইল। ওদিকে দুভায়ের ঝগড়া খালি বাড়ছে বাড়ছে আর বাড়ছে।
“তুই একটা বেবুন!”
“তুই বেবুন।”
“তুই একটা সাবান।”
“তুই সাবান।”
তখন শেয়ালদাদা, মাথায় ভীষণ বুদ্ধি, তাই মাথায় একটা টুপি পড়ল। আর নাকে চশমা। দেখি কী করা যায় ...
গুটি-গুটি-গুটি-গুটি হাটল শেয়ালদাদা।
“কী রে, তোরা ঝগড়া করছিস কেন?”
“এই যে শেয়ালদাদা, বল দিকিনি এই সোনার টোপরটা কার?”
“হ্যাঁ যা তুমিই বলতো ঠিক করে, ওটা কার?”
“সোনার টােপর নিয়ে ঝগড়া করছিস?” বলেই শেয়ালদাদা করলে কী, কাছেই একটা টুল ছিল, লেজটা দিয়ে সেই টুলের ধুলো বেশ করে ঝাড়ল। তারপর গ্যাট হয়ে বসল টুলের ওপর।
“এই যে।” হুকু তাড়াতাড়ি সোনার টোপরটা এনে দিল। শেয়ালদাদা চশমাটা খুলে সোনার টোপরটা চোখের কাছে এনে ভালো করে দেখল।
“হুঁ।”
তারপর আবার চশমা পরে বলল, “কেমন করে পেলি?”
“মাটি খুঁড়ে।” হুকু বলল।
“ই, কী দিয়ে মাটি খুঁড়েছিস?”
“এই কোদাল দিয়ে।” ভুকু বলল।
“হুঁ, কতবার মাটি কুপিয়েছিস?”
হুকু মাথা চুলকোতে লাগল। ভুকু গাল চুলকোতে লাগল। ঠিক কতবার মাটিতে কোপ বসিয়েছে হুকু? ভুকুই বা কতবার কুপিয়েছে—তা কি কেউ গুনে রাখে?
“কী-রে, রা-নেই কেন?” শেয়ালদাদা হুকুর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায়, “কতবার কুপিয়েছিলি?”
হুকু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। যার মাথা চুলকোয়। শেষে একটা ধমক খেয়ে ঘাবড়ে-টাবড়ে হাঁচ্চো-ট্যাঁচ্চো অনেক কিছু করে হুকু ফস করে বলে ফেলল, “ছেষট্টিবার।”
আর তুই ?” শেয়ালদাদা ভুকুর দিকে তাকাতেই ভুকু ঢোঁক গিলতে গিলতে বলল, “আমিও ছেষট্টিবার।”
দুজনেই সমান মাটি কুপিয়েছ? ওহ-হো, বেজায় মুশকিলে ফেললে। শেয়ালদাদা মাথার টুপিটা খুলে ফেলল। একহাতে সোনার টোপর আর আরেকহাতে টুপি নিয়ে বলল,“তোদের কি মাটি খোড়ার কাজ শেষ হয়েছে?”
“উহুঁ।”
“তা হলে মাটি খোড়ার কাজ শেষ কর।” বলেই শেয়ালদাদা সোনার টােপরটা মাথায পড়ল, “এখন এই সোনার টোপরটা আমার মাথাতেই থাক। মাটি খোড়া শেষ হলে তোদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশিবার মাটিতে কোপ বসাবে সে-ই এই সোনার টোপর পাবে। বুঝলি? নে, চট্পট্ মাটি খোড়া শেষ কর।”
তক্ষুনি হুকু কোদাল হাতে নিল। ধুপ করে মাটিতে কোপ বসিয়ে দিয়ে বলল, “হেই সাতষট্টি।”
“এ কী, হুকু যে বেশিবার মাটিতে কোপ বসাবে। তাই ভুকুও তাড়াতাড়ি একটা কোদাল নিয়ে, ধুপ করে একটা কোপ বসিয়ে দিয়ে বলল, “হেই সাতষট্টি।”
হুকু তখন আবার কোপ বসাল। “হেই আটষট্টি।"
সঙ্গে সঙ্গে ভুকুও কোপ বসাল, “হেই আটষটি।’
“হেই উনসত্তর।”
“হেই উনসত্তর ”
“হেই সত্তর।”
“হেই সত্তর।”
একটু পরে শেয়ালদাদা টোপর মাথায় উঠে দাঁড়াল। টুপিটা টুলের ওপর রাখল। বলল, “শোন হুকু ভুকু, আমি একটু ঘুরে আসছি বাজার থেকে। আমি যে পালাচ্ছি না তার প্রমাণ, আমার এই টুপিটা তোদের টুলে রেখে গেলাম। বুঝলি তো? এবার তোদের মাটি খোড়ার কাজ শেষ কর।”
“আচ্ছা।” হুকু ঘাড় নাড়ল ।
“আচ্ছা।" ভুকু ঘাড় নাড়ল। তারপর আবার মাটি খোড়া শুরু করল, “হেই একশ বত্রিশ।”
“হেই একশ বত্রিশ।"
তারপর—
তারপর শেয়ালদাদা চম্পট ।
না না, চম্পট নয়। শেয়ালদাদা খুউব ভালো। পাড়াপড়শীদের সঙ্গে যুক্তি করে সোনার টোপরটা জাদুঘরে রেখে এল। আর হুকু ভুকু? তারা মাটি খুঁড়েই যাচ্ছে, “হেই একলক্ষ বারো হাজার তিনশ সাতাশ।”
“হেই একলক্ষ বারো হাজার তিনশ সাতাশ।”
গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।
0 coment�rios: