কোন এক গ্রামে দাসু নামে এক কিসান ছিল । তার জমির ফসল দিয়ে সারা বছর কোন রকমেই চলতনা। তাই তাকে ধার করতে হোত । ধার বাড়তে বাড়তে এমন দিন এলো যখন সে আর ঐ ধার শোধ করতে পারল না।
“থাকলে খাব আর না থাকলে উপোষে কাটাব । জমি বিক্ৰী করে ধার শোধ করে দেওয়াই ভাল ।” এই কথা দাসুর বউ বলল দাসু জমি বিক্ৰী করতে চেচষ্টা করতে লাগল। বিপদে পড়ে বিক্ৰী করছে জেনে গ্রামের লোক জলের দামে কিনতে চাইল তার জমি ।
ঐ গ্রামেই শ্রীনিবাস নামে আর একজন কিসান ছিল । ঠাকুরদার আমলে দাসুদের অবস্থা ভালই ছিল। সেই আমলে শ্রীনিবাসদের ঠাকুরদা দাসুদের ঠাকুরদার কাছে সাহায্য নিয়ে ছিল । তাই শ্রীনিবাস ন্যায্য দর দিয়ে দাসুর জমি কিনল ।
সেই টাকা দিয়ে দাসু সমস্ত ধার শোধ করে সংসার চালাবার জন্য দিন মজুরী করতে বেরুলো । সেই কথা জানতে পেরে শ্রীনিবাস দাসুকে বলল, “মজুরীই যদি করতে হয় তো তোমার বিক্ৰী করা জমিতেই কাজ করনা কেন । তোমার খরচ চালাবার ভার আমি নিচ্ছি।”
“তাহলে তো ভালই । আমার কাছে আপনি ভগবান ।” দাসু বলল । এবং সেই দিন থেকেই শ্রীনিবাসের জমিতে কাজে লেগে গেল ।
একদিন জমিতে কাজ করার সময় দাসুর লাঙ্গলের ফলায় কী যেন ঠেকল । জমি খুঁড়ে দেখে দুটি ঘড়া । ঘড়াগুলো তুলে তার মুখ খুলে দেখতে পেল তার ভেতরে রয়েছে অনেক সোনার অলঙ্কার এবং মোহর ।
দাসু তাড়াতাড়ি সেই ঘড়া দুটো বয়ে আনল শ্রীনিবাসের বাড়িতে। দাসু বলল, “ঘড়া দুটো সাবধানে রাখুন। এসব আপনার জমিতে পেয়েছি । ক্ষেতে লাঙ্গল আর বলদ রেখে এসেছি । তাড়াতাড়ি যেতে হবে ।”
দাসুর কাণ্ড দেখে শ্রীনিবাস অবাক হোল । এতখানি সততায় সে আশ্চর্য হল। পরে বলল, “দাসু, তোমার সততার জন্য কী যে বলব ভেবে পাচ্ছিনা। এত অলঙ্কার গিণি তুমি রেখে দিতে পারতে । আর তা না করে তুমি আমার বাড়িতে এনে দিলে ! শোন, ঐ জমিটা তো তোমার কাছ থেকেই কিনেছি। তাই ন্যায় বিচারে ঘড়াগুলো তোমারই।"
“তাকি কখনও হয়। ঐ জমি আপনার কাছে বিক্ৰী করে দিয়েছি । অতএব, ঐ জমিতে যা পাওয়া যাবে সব আপনারই। আমার কি করে হবে ? আপনি দয়া করে আপনার ঐ জমিতে আমাকে কাজ করতে দিলেন । ইচ্ছে করলে অন্য কাউকে দিয়েও ঐ জমিতে কাজ করাতে পারতেন।” দাসু বলল ।
“দেখ দাসু, জমিতে যে ফসল উঠবে তার উপর আমার হক অাছে ঠিক কিন্তু তাই বলে এসব উঠলে কি আমার নেওয়া উচিত? আমি কি সে রকম দাম দিয়ে কিনেছি ? এ জমিতে তুমি কেন অন্য কোন লোক কাজ করলেও এই ঘড়া দুটো আমি তোমাকেই দিতাম । অন্যায় করলে ভগবানের কাছে ক্ষমা পাব?” বলল শ্রীনিবাস।
“আমিও তো সেই কথাই বলছি বাবু, ঐ ঘড়া থেকে একটি মুদ্রাও যদি নি, অামি কি ভগবানের কাছে ক্ষমা পাব ? অধৰ্ম হবে না ?” দাসু বলল ।
তারা দুজনে গ্রামের বিপারপতির কাছে গেল। যে যার বক্তব্য বলল। ঐ সময়ে । গ্রাম অধিকারীর ছোট ভাই গোপীনাথ সেখানেই ছিল ।
দাসুর আর শ্রীনিবাসের কথা গ্রাম অধিকারীর কাছে অদ্ভুত ঠেকল । সব কথা শুনে বলল, “এর জন্য এত হৈ চৈ এর কী আছে । দুজনের প্রত্যেকে একটি করে ঘড়া নিয়ে নিলেই তো হয় ।"
এই বিচারে তাদের দুজনের কেউই খুশি নয় । দুজনই বলল এটা অন্যায় । গোপীনাথ এগিয়ে এসে বলল, “আমার কথা মতো কাজ করলে তোমরা দুজনেই ন্যায় বিচার পাবে ।”
“বেশ, তাই বলুন !" দাসু এবং শ্রীনিবাস বলল ।
“তোমরা দুজনেই একটা করে ঘড়া নিয়ে গিয়ে যে যার বাড়িতে এক মাস রাখ। এক মাস পরে বিচার চাও তো হবে ।” গোপীনাথ বলল ।
দুজনে একটা করে ঘড়া নিয়ে গেল যে যার বাড়িতে ।
তাদের চলে যাওয়ার পর গ্রাম অধিকারী তার ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, এ তুমি কেমন বিচার করলে ? এক মাস পরে আমি কী বিচার করব ?"
“এক মাস পরে ওরা তোমার কাছে বিচার চাইতে এলে তো ?” গোপীনাথ কেমন নিশ্চিন্তে হাসতে হাসতে বলল ।
"কেন ? আসবেনা কেন ?" গ্রাম অধিকারী আশ্চর্য হয়ে বলল ।
“মাত্র একসপ্তাহ ধৈর্য ধর, তারপর দেখতে পাবে।” বলল গোপীনাথ ।
একসপ্তাহ কেটে গেল । একদিন মাঝ রাতে গোপীনাথ দাদাকে নিয়ে দাসুর বাড়ির জানালার পাশে দাঁড়াতে বলল । ঘরের ভেতর থেকে দাসুর কথা শুনতে পেল, “আগেকার সেই খাটাবার শক্তি গতরে আর নেই । বাচ্চারাও তো বড় হচ্ছে । ন্যায্য তো দুটো ঘড়া আমারই নেওয়া উচিত ছিল । জমি বিক্রীর আগে পেলে তো কথাই ছিলো না । কিন্তু এখন এত কাণ্ডের পর দুটো ঘড়াই আমাকে দেওয়া হোক বললে লোকে হাসবে। তার চেয়ে এই ঘড়াতে যা আছে তাই দিয়ে জমি কিনে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দি ” বলল দাসু ।
সেখান থেকে গ্রাম অধিকারী এবং তার ছোট ভাই গোপীনাথ গেল শ্রীনিবাসের বাড়ির কাছে । সেখানে শুনতে পেল, “দাসুর কথামতো দুটো ঘড়াই রেখে দিলে পারতাম, জমি যখন আমি কিনেছি । ঐ জমির ঘড়াগুলোতো আর দাসু জমিতে পুঁতে রাখেনি। কিন্তু এখন এই একটা ঘড়া নিয়েই আমাকে খুশী থাকতে হবে।” বলল শ্রীনিবাস ।
বাড়ি ফিরতে গোপীনাথকে দাদা বলল,“তোমার কথাই দেখছি সত্য ! কিন্তু সেদিন ওদের কথা শুনে মনে হয়েছিল, দাসু আর শ্রীনিবাস খুব নীতি মেনে চলে। আচ্ছা, ওদের আসল ব্যাপারটা তুমি কেমন করে টের পেলে বল দেখি ?”
“ওদের নীতি আর সততার তুমি ওভাবে বিচার করনা । নীতিহীন হলে দাসু ঐ ঘড়া দুটো শ্রীনিবাসকে কিছুতেই দিতো না। শ্রীনিবাসও নীতিহীন নয় বলেই ঐ ঘড়া দুটো নিতে চাইল না। কিন্তু টানা একসপ্তাহ ধরে ধনলক্ষী চোখের সামনে, থাকলে যত বড় নীতিবানই হোক না কেন টলে যেতে বাধ্য । এইটাই তো মানুষের স্বভাব ।” বলল গোপীনাথ !
[[[ গল্পটি জনপ্রিয় ছোটদের মাসিক পত্রিকা “চাঁদমামা- আগষ্ট,১৯৭২” থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। গল্পটি লিখেছেন, “আশুতোষ দে”। এই ধরনের একটি গল্প “কাজাখের লোকাহিনীতেও পাওয়া যায়। এই সাইটে “অপূর্ব বাগান” লিখে সার্চ দিলে গল্পটি পাবেন।]]]
0 coment�rios: