কাককে কেহ ভালবাসে না। তার গায়ের রং কালো। কথার সুরও কর্কশ । তাই বলিয়াই কি কাককে অবহেলা করিতে হইবে ? সকলেই কি সুন্দর ? সকলের স্বরই কি মিষ্টি ? যেখানে আবর্জনার মধ্যে দু’একটি খাবার জিনিস পড়িয়া থাকে, কাক তা খুঁটিয়া খায় ; ইঁদুর, আরসুলা, ব্যাঙ মরিয়া গেলে কাক তা কুড়াইয়া খায়।
মাটির উপর যে কত রকমের পোকা জন্মে। কাক সেগুলি খুঁটিয়া খায়। এজন্য জার্মানির বিজ্ঞানীরা কাকের কত তারিফ করে |
কাক না থাকিলে সেগুলি পচিয়া গন্ধ হইত। পথ চলা যাইত না। সবজি বাগানে, শস্যক্ষেতে পোকা লাগে। অন্যান্য পাখিদের মতো কাকও তাহাদের ধরিয়া খায় । সেইজন্যই ত বাগানভরা এত রকমের সবজি। ক্ষেতভরা এত রকমের শস্য। তবু সবাই কাককে অবহেলা করে। কাছে আসিলে দূরদূর করিয়া তাড়াইয়া দেয় ।
কাকের ভারি ইচ্ছা করে, আর-সব পাখিদের সঙ্গে সে খুব ভাব করে । তাদের সঙ্গে মিশিতে পারিলে সে জাতে উঠিতে পারে। কিন্তু কে তাহার সঙ্গে বন্ধুত্ব করিবে ? কোকিল যদিও কাকের মতো কালো, কিন্তু তাহার গানের সুর লইয়া কবিরা এত কিছু লিখিয়াছে যে, সে গুমরেই তাহার সঙ্গে কথা বলিবে না । কাকাতুয়া, ময়না, বুলবুল এরাও একই জাতের । কিন্তু কি করিয়া সে নিজের অচ্ছুৎ নাম ঘুচাইবে,-- কি করিয়া সে দলে উঠিবে ? ছোট চড়াই পাখিটা দূৰ্বাঘাসের উপর খেলা করিতেছিল। কাক যাইয়া তাহাকে বলিল, “চড়ুই ভাই! তুমি আমাকে তোমার জোটে লইবে? তুমি আমার বন্ধু হইবে ?”
চড়ুই বলিল, “তুমি কাক । অচ্ছুৎ। সব সময় নোংরা থাক । তোমার সঙ্গে কে বন্ধুত্ব করিবে ?”

কাক বলিল, “দেখ ভাই! আমি গরিব কাক । টাকা পয়সা নাই যে, আর-সব পাখিদের মতো রং-বেরঙের পোশাক পরিব। আমি পথে-ঘাটের কত নোংরা জিনিস খাই । সেইজন্যই আমি কিছুটা নোংরা। কিন্তু একথাটাও মনে রাখিও, আমি না থাকিলে পথে-ঘাটে দুর্গন্ধ হইত। তোমরা চলিতে পারিতে না । দেখ ভাই ! তুমি যদি আমার বন্ধু হও, তবে তোমার নিকট হইতে আমি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার শিক্ষা লইব । বুনিয়াদি ঘরের তোমরা, আমাদের সঙ্গে মেশ না বলিয়াই তো আমরা ভাল হইয়া থাকিবার শিক্ষা পাই না।”
চড়ুই পাখি ভাবে, একটা ছোটলোক আসিয়া কি বকর বকর লাগাইল! কিন্তু সে বড় ঘরের ছেলে, মুখে একটু ভদ্রতার ভাব দেখাইয়া বলিল, “আচ্ছা যা নদী হইতে ঠোট দুইটি ভালমতো ধুইয়া আয় । তখন তোর সঙ্গে মেলামেশা করিব।”
নদী যে তার পানিতে কাককে ঠোঁট ধুইতে দিবে না, চড়ুই তাহা জানিত ।
কাক নদীর কাছে যাইয়া বলিল,
“নদী ভাই! নদী ভাই!
দাও জল, ধুব ঠোঁট,
তবে নেব চড়ুইর জোট ।"
নদী বলিল, “দূর বেটা কাক! তুই আচ্ছুৎ। আমার জলে যদি তোর ঠোঁট ধুইতে দেই, তবে আমিও আচ্ছুৎ হইব । ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা আর আমার জলে নাহিতে আসিবে না।” মুখখানা বেজার করিয়া কাক চলিয়া যাইতেছিল ।
নদীর একটু দয়া হইল। বলিল, “দেখ, কাক! একটি ঘটি লইয়া আয় । তাতে করিয়া জল তুলিয়া ঠোঁট ধুইস।”
কিন্তু ঘটি কোথায় পাওয়া যায় ? কাক কুমারের বাড়িতে গেল ।
“কুমার ভাই! কুমার ভাই!
দাও ঘটি, ভরব জল,
ধুব ঠোঁট, তবে নেব চড়ুইর জোট ।”
কুমার বলিল, ঘটি ত নাই। তবে মাটি যদি লইয়া আসিতে পারিস আমি ঘটি গড়াইয়া দিতে পারি।"
কাক তখন মোষের কাছে যাইয়া বলিল,
“মোষ ভাই! মোষ ভাই!
খুঁড়বে মাটি, গড়বে ঘটি,
ভরব জল, ধুব ঠোঁট,
তবে নেব চড়ুইর জোট ।”
মোষ বলিল, “আমি কেমন করিয়া মাটি খুঁড়িব! রাখাল আমাকে ঘাস দেয় না। আজ সাতদিন কিছুই আহার করি না।”
কাক তখন মাঠের কাছে গেল,
“মাঠ ভাই! মাঠ ভাই!
দে তো ঘাস, খাবে মোষ
ভরব জল, ধুব ঠোঁট,
তবে নেব চড়ুইর জোট ।”
মাঠ বলিল, “ঘাস ত আছে ; কিন্তু কাটিয়া দিবে কে ?”
কাক তখন রাখালের কাছে গেল,
“রাখাল ভাই! রাখাল ভাই!
কাটো ঘাস, খাবে মোষ,
খুঁড়বে মাটি, গড়বে ঘটি,
ভরব জল, ধুব ঠোঁট,
তবে নেব চড়ুইর জোট ।”
রাখাল বলিল, “কি দিয়া ঘাস কাটিব ? আমার যে কাস্তে নাই ।”
কাক তখন কামারবাড়ি গেল,
“কামার ভাই! কামার ভাই!
গড় কাস্তে, নেবে রাখাল,
কাটবে ঘাস, খাবে মোষ
ভরব জল, ধুব ঠোঁট,
তবে নেব চড়ুইর জোট ।”
কামার বলিল, “কি করিয়া কাস্তে গড়িব ? আগুন নিভিয়া গিয়াছে। আগুন লইয়া আয়, তবে কাস্তে গড়িব ।”
কাক তখন গেরস্তবাড়িতে গেল,
“গেরস্ত ভাই! গেরস্ত ভাই!
দাও আগুন, গড়বে কাস্তে,
কাটবে ঘাস, খাবে মোষ,
তবে নেব চড়ুইর জোট ।”
গেরস্ত তখন এক হাতা আগুন আনিয়া কাককে দিল । কিসে করিয়া আগুন লইবে কাক ?
কিন্তু আগুন লইয়া না গেলে ত সে জাতে উঠিতে পারবে না । অচ্ছুৎ হইয়া থাকার চাইতে মরণও ভাল ।
সে তার পাখা পাতিয়া দিল আগুন লইবার জন্য । পাখায় আগুন লইয়া যেই কাক আকাশে উঠিয়াছে, অমনি সে পুড়িয়া মরিয়া গেল ।
0 coment�rios: