তিন বন্ধু। তাদের মধ্যে দুই বন্ধু বড় অলস। কোন কাজ তারা করে না, কেবল বসে বসে খায় আর বেড়িয়ে বেড়ায়। আর একজন খুব পরিশ্রমী। কখনও চুপ করে বসে থাকে না। সব সময় কাজ করে বেড়ায়। ফলে রোজগার করে বেশী। ক্রমে সে অনেক টাকা জমিয়ে ফেলল। এবার মনে ভাবল, সে বিদেশে ব্যবসা করবে।
এদিকে অলস দু্ই বন্ধু বুঝতে পেরেছে পরিশ্রমী বন্ধু অনেক টাকা জমিয়েছে। এখন দিনরাত তাদের পরামর্শ চলছে, কি করে ঠকিয়ে টাকাগুলি হাত করা যায়। কিন্তু কোন সুযোগ হয় না। পরিশ্রমী বন্ধু সব সময় সজাগ আর সতর্ক। কিন্তু যখন তারা শুনল, পরিশ্রমী বন্ধু বিদেশে ব্যবসা করতে চায়, তখন তারা বলল, চল বন্ধু, আমরা এদেশ ছেড়ে চলে যাই। আমরাও তোমার সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য করব। এখানে কিছুই হচ্ছে না। যেখানে কাজ কর্ম করে খেতে পাওয়া যায় না, সেখানে থেকে লাভ কি?
একদিন তিনজন বার হল দেশ ছেড়ে। তারা চলতে লাগল। ক্রমে তারা এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গেল; এক বন ছেড়ে অন্য বনে। কত নদী পার হল, কত পাহাড় ডিঙ্গিয়ে গেল কিন্তু কোথাও কারো কোন সুবিধা হলো না। তবু তিনবন্ধু চলছেই।
একদিন চলতে চলতে রাত হয়ে গেল। তখন তারা এক বনের মধ্যে এসে পড়েছে। আর এগোবার কোন উপায় নেই। বাধ্য হয়েই তারা সেখানে রয়ে গেল। এই বনেই রাত কাটাতে হবে।
অলস বন্ধু দু’জনে নিজেদের ভাগ্য ফিরাবার খুবই চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। তাই তারা ঠিক করল, পরিশ্র্রমী বন্ধুর টাকা নিয়ে সুখে স্বচ্ছন্দে থাকবে। জীবনে আর কিছুই করতে হবে না। পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে খাবে। এবার এক সুযোগ এসে গেল।
পরিশ্রমী বন্ধু ঘুমিয়ে আছে। সারাদিনের খাটুনিতে খুবই ক্লান্ত। অলস বন্ধুরা সুযোগ বুঝে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার চোখদুটো অন্ধ করে দিল। পরে তাকে দড়ি দিয়ে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে তার সব টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে চলে গেল।
অন্ধ বন্ধু মনে মুঃখে মনের মধ্যে কেঁদে কেঁদে রাত কাটিয়ে দিল। শেষ রাতে তার মনটা অনেক শান্ত হল; ভাবল, কেঁদে আর কি হবে? চোখ ত আর ফিরে পাব না। বরঞ্চ ঈশ্বরকে ডাকি। ঈশ্বরের দয়ায় কি না হয়। তাই সে আকুলভাবে ঈশ্বরকে ডাকতে লাগল। গাছের সঙ্গে শরীর বাঁধা, তাই সে বসতেও পারছে না, শুতেও পারছে না। সুতরাং সে দাঁড়িয়েই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগল।
এখন সেই গাছের উপরে ছিল দুটো সুখপাখি। একটা শুক আর একটা শুককে বলছে, রাজার মেয়ের খুব অসুখ। তার অসুখ কিছুতেই সারছে না।
--আর একটা শুক জিজ্ঞেস করল, কি করে অসুখ সারবে?
প্রথম শুক জবাব দিল, এ গাছের নীচে যে ফুলগাছটা আছে, তাই পুড়িয়ে ছাই করতে হবে। জলের সঙ্গে সেই খাইয়ে দিলে, রাজকুমারী সেরে উঠবে।
দ্বিতীয় শুক আবার জিজ্ঞেস করল, এই যে অন্ধ লোকটি এখন গাছের সঙ্গে বাঁধা, এর চোখ কি করে সারবে?
প্রথম শুক জবাব দিল, আজ ভোরে যে শিশির পড়বে, সেই শিশির যদি সে চোখে মাখে, তাহলেই তার চোখ সেরে যাবে।
দ্বিতীয় শুক আবার জিজ্ঞেস করল, রাজ্যের আর খবর ক?
প্রথম শুক জবাব দিল, রাজ্যে বড় জলের অভাব। লোকের বড় কষ্ট। কিন্তু এ কষ্ট কেমন করে ধুর করা যায়, তা কেউ জানেনা। আমি তা জানি। রাজ্যে একটা বাজার আছে। বাজারের কাছে একটা বড় মাঠ। বড় মাঠটার পূর্ব কোণে একটা চৌকো পাথর আছে। ঐ চৌকো পাথরের নীচের মাটি খুঁড়তে পারলে বার হবে একটা ঝরনা। এই ঝরনা থেকেই রাজ্যের জলের অভাব মিটতে পারে।
লোকটি শুনতে পেল সব কথা। এবার আবার তার মনে সাহস এল। সে ঠিক করল, সে আবার বাঁচবার চেষ্টা করবে। এইভাবে মরা তার চলবে না। তাকে বাঁচতেই হবে।
এমনি সময় হঠাৎ তার পায়ে ঠেকল একটা ছোট পাথর। পায়ের আঙ্গুল দিয়ে কোনমতে সেই পাথরটা সে হাতে তুলে নিল। তারপর দড়িতে সে পাথর ঘসে ঘসে সে বাঁধন কেটে ফেলল। এবার সে মুক্ত। ইচ্ছামত সে চলাফেরা করতে পারবে। মুক্ত হয়েই সে শিশির খুঁজতে শুরু করল।
তখন ভোর হয়েছে। বনের মধ্যে প্রচুর ঘাস। সে ঘাসে পড়েছে অনেক শিশির। হাতড়ে হাতড়ে সে সেই শিশির নিয়ে চোখে লাগাতেই, চোখ তার ভাল হয়ে গেল। এই ত বেশ সে দেখতে পাচ্ছে! এই ত বনের গাছপালা! আকাশে ঐ ত সূর্য উঠেছে! মনের আনন্দে সে লাফিয়ে উঠল।
এমন সময় তার নজরে পড়ল ফুলগাছটা। এই গাছের কথাই ত শুকপাখি বলেছে। সে একটা ফুল তুলে নিয়ে সেটাকে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলল। আর সেই ছাই কাপরের খুঁটে বেঁধে নিল। তারপর সে রওনা হল, সেই রাজ্যের দিকে, যে রাজ্যে রাজার মেয়ের অসুখ সারছে না।
দু’দিন হেঁটে সে পৌছল রাজধানীতে। সেখানেই সে শুনতে পেল রাজা ঘোষনা করেছেন, যে রাজকণ্যার চোখ সারাতে পারেন, তারই সঙ্গে রাজকুমারীর বিযে হবে। আর যে সারাতে পারবে না, তার গর্দান নেওয়া হবে।
একদিন সকালবেলা। রাজবাড়ীর দেউড়ীতে দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে এসে সে বলল, আমি রাজকণ্যার অসুখ সারাব।
দারোয়ান বলল, ভাই, তুমি ফিরে যাও। কেউ যা পারেনি, তা তুমি পারবে কি করে? কত হাকিম, কত বদ্যি, কত সাধুসন্ন্যাসী এল। কেউ আর প্রাণে নিয়ে ফিরে যেতে পারল না। সবারই গর্দান গেল। তুমি মিছেমিছে কেন প্রাণটা দেবে। ফিরে যাও।
লোকটি বলল, আমার প্রাণ যায় যাবে। তুমি রাজাকে খবর দাও।
দারোয়ান আর কি করে। রাজাকে গিয়ে জানাল, মহারাজ, একটা লোক এসেছে। সে বলছে রাজকন্যাকে সারিয়ে তুলবে।
রাজা হুকুম দিলেন, নিয়ে এস।
লোকটি গিয়ে ধীরে ধীরে রাজকুমারীর বিছানার কাছে দাঁড়াল। একজন দাসীকে বলল, একটা পাত্রে জল নিয়ে আসতে। দাসী জল নিয়ে এল। লোকটি নিজের কাপড়ের খুঁটি খুলে ফুলের ছাই জলে মিশিয়ে রাজকুমারীকে খেতে দিল।
দু’দিন পরেই রাজকুমারী ভাল হয়ে গেল। রাজা-রাণীর আনন্দের আর সীমা নেই। প্রাসাদের মধ্যে উৎসব শুরু হল। নাচে গানে রাজধানীর রোক একেবারে মেতে উঠল।
লোকটিকে রাজবাড়ীতে নিযে আসা হলো।
সে একদিন রাজাকে বলল, দেখছি, রাজ্যে বড় জলের কষ্ট। আপনি এক কাজ করুন। বাজারের কাছের মাছের পূর্ব দিকে একটা চৌকো পাথর আছে। তার নীচের মাটি কাটুন। বেরুবে একটা ঝরনা, এই ঝরনায় রাজ্যের জলের অভাব মিটবে।
তৎক্ষণাৎ রাজার লোক গের বাজারে। সত্যিই বাজারের কাছের মাঠের পূব দিকে পড়ে আছে একটা চৌকো পাথর। পাথর সরানো হল। মাটি কাটা হলো। সঙ্গে সঙ্গেই ঝরনার জল উছলে উঠল। রাজা ত মহাখুশী। রাজ্যের লোক আনন্দে আত্মহারা। রাজকুমারীর সঙ্গে লোকটির বিযে হয়ে গেল। এখন সে রাজার জামাই। বড়ই সুখে তার দিন কাটছে।
একদিন রাজার জামাই বেড়াতে বেরিয়েছে। সঙ্গে তার লোকজন কেউ নেই। খানিক দূর গিয়েই সে দেখে ছোট একটা কুঁড়ে ঘরে দুজন লোক বসে আছে। দেখেই সে তার দুই দুষ্টবন্ধুকে চিনতে পারল। সে তাদের কাছে গিয়ে বলল, লোভে পড়ে তোমরা আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিলে। বনের মধ্যে ফেলে গিয়েছিলে। আমার টাকা পয়সা কেড়ে নিয়েছিলে। কিন্তু দেখ, ঈশ্বর আমাকে বাঁচিয়েছেন। এখন এ রাজ্যের আমি ভবিষ্যৎ মালিক। আমি হুকুম করলে এখনই প্রহরীরা তোমাদের বন্দী করবে।
দুষ্ট বন্ধু তাড়াতাড়ি পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল, তারপর বলল, বাঁচাও ভাই, আমাদের বাঁচাও। আমরা জীবনে আর পাপের কাজ করব না।
রাজার জামাই আসলে খুব ভাল লোক। সে তাদের ক্ষমা করল। শুধু তাই নয়। রাজাকে বলে তাদের রাজসরকারে চাকরি করে দিল।
দুষ্টবন্ধুদের স্বভাব একেবারে বদলে গেল।
[-- শ্রী ক্ষিতীশচন্দ্র কুশারী]
0 coment�rios: