গ্রামের মধ্যে সবচাইতে বড়লোক আমাদের খাঁ সাহেব; কিন্তু বড়ই কৃপণ। একটি পয়সাও তার হাতের কানি আঙুল দিয়া পড়ে না। তার বাড়িতে কেহ কোনদিন দাওয়াত খাইতে পায় না।
সেবার তাহার ছেলের বিবাহ। সমস্ত গ্রামের লোক আসিয়া ধরিল, “খাঁ সাহেব! এবার আর আপনাকে ছাড়িব না; আপনার ছেলের বিবাহ। আমাদিগকে দই চিনি খাওয়াইতে হইবে।”
খাঁ সাহেব অনেক আপত্তি করিল, ‘এ বছর ক্ষেতের ধান তেমন হয় নাই। পাটের দামও কম। দই-চিনি বাদ দাও। আমি তোমাদিগকে মাছ-ভাত খাওয়াইব।’
কিন্তু গ্রামের সমস্ত লোককে দই-চিনি খাওয়াইতে হইলে অনেক টাকা খরচ হইবে। সারারাত্র এই খরচের চিন্তায় তাহার ঘুম হইল না। শেষরাত্রে খাঁ সাহেব মনে মনে একটি ফন্দি আঁটিল।
সকাল হইলে সে মতি গোয়ালার বাড়ি যাইয়া তাহাকে ঘুম হইতে জাগাইল। মতি চোখ মুছিতে মুছিতে জিজ্ঞাসা করিল, ‘তা খাঁ সাহেব কি মনে করিয়া?’
খাঁ সাহেব বলিল, ‘দেখ মতি! কাল আমার ছেলে বিবাহ। তোমাকে দশ মণ দই দিতে হইবে।’
মতি খুশি হইয়া বলিল, ‘সে আর এমন বেশি কথা কি? আমি ঠিক সময়ে দই লইয়া হাজির হইব।’
খাঁ সাহেব গোয়ালোকে আর একটু নিকটে ডাকিয়া বলিল, ‘দেখ মতি! এর মধ্যে আমার একটি কথা আছে। তুমি আমাকে একমণ মিষ্টি দই দিবে। আর বাদ বাকি কয়মণ দই টক তৈরী করিবে।’
মতি আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘খাঁ সাহেব! সকলেই ত মিষ্টি দই চায়। আপনি টক দই চান কেন?’
খাঁ সাহেব হাসিয়া বলিল, ‘দেখ মতি! তুমি বুঝিবে না। তুমি যদি আমাকে মিষ্টি দই দাও, তবে দশমণে কুলাইবে না। গ্রামবাসীরা যেমন রাক্ষসের মতো খায়, বিশমণে কুলাইবে না। তাদের পেট ভরাইতে পারিব না। সে অনেক টাকার খরচ।’
গোয়ালা হাসিয়া বলিল, ‘আচ্ছা! আপনি যেমন যেমন বলিয়াছেন, সেইভাবেই দই তৈরী করিব।’
খাঁ সাহেব গোয়ালার কানে কানে বলিল, ‘দেখ মতি! আরও একটি কথা কথা, তোমার টক দই খাইয়া গ্রামের লোকেরা যখন নিন্দা করিবে, তখন আমি তোমাকে বকিব কিন্তু তুমি একটি কথাও বলিতে পারিবে না। এ জন্য আমি তোমার টক দইয়ের প্রতি মণের দামে আরও চার আনা করিয়া ধরিয়া দিব। মনে থাকে যেন, আমি টক দই আনার জন্য তোমাকে যতই গালাগালি দিব, তুমি টুঁ শব্দটিও করিবে না।’
মতি হাসিয়া বলিল, ‘আচ্ছা।’
নিমন্ত্রনের দিনে গ্রামের লোক খাইতে আসিয়াছে। মাছ-ভাত খাওয়ার পর প্রত্যেকের পাতে যখন মিষ্টি দই পড়িল; তখন সকলেই খাঁ সাহেবের তারিফ করিতে লাগিল। কিন্তু এক চামচ দুই চামচ করিয়া যখন টক দই পড়িতে লাগিল, তখন সকল লোকের মধ্যে হৈচৈ পড়িয়া গেল। কেহ খাওয়া ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িল, কেহ খাঁ সাহেবকে গালি পাড়িতে লাগিল।
খাঁ সাহেব তখন গোয়ালাকে ডাকিয়া খুব রাগের সঙ্গে বলিল, ‘দেখ! তুমি এত টক দই দিয়াছ কেন?’


গোয়ালা কোন কথা বলে না। খাঁ সাহেব গলা আরও চড়াইয়া বলে, ‘কি, এখন যে মুখ দিয়া কথা বাহির হয় না। বেটা পাজি নচ্ছর এত টাকা দাম লইয়া আমাকে টক দই দিয়াছিস? দাঁড়া, তোকে আমি মজা দেখাইতেছি!’
গোয়ালা তখনও কথা বলে না।
খাঁ সাহেব আরও রাগিয়া বলে, ‘বেটা নচ্ছার! ভাবিয়াছিস তোকে আমি এমনি ছাড়িয়া দেব? এত লোকের খাওয়া নষ্ট করিলি, তার শাস্তি তোকে দিব না?’
তাহাকে এইভাবে বকিতে বকিতে খাঁ সাহেবের মাথা গরম হইয়া উঠিল। রাগের মাথায় গোয়ালার মুখে বিরাশির দশ অানা ওজনের থাপ্পর মারিয়া বসিল।
মার খাইয়া গোয়ালা নিমন্ত্রিত লোকদের সামনে দাঁড়াইয়া জোড়হাত করিয়া বলিল, ‘দেখেন, সব লোকজন আপনারা দশজনে ইহার বিচার করেন। খাঁ সাহেব কোরান শরিফ মাথায় লইয়া বলুন, দই টক হইলে আপনারা কম খাইবেন, তাই আমাকে টক দই আনার জন্য বায়না দিয়াছিলেন কি না?
শুনিয়া গাঁয়ের সকল লোক খাঁ সাহেবের উপর ভীষণ চটিয়া গেল। খাঁ সাহেব নরম হইয়া কানে কানে আস্তে গোয়ালেকে বলিল, ‘কিরে মতি, তোর সঙ্গে কথা হইয়াছিল না, টক দই দেখিয়া আমি রাগারাগি করিব, তুই কিছু বলিবি না? এখন কেন সকল কথা ফাঁস করিয়া দিলি?’
গোয়ালা আরও আস্তে আস্তে খাঁ সাহেবকে বলিল, ‘আপনার সঙ্গে চুক্তি হইয়াছিল, আপনি যতই গালাগালি করিবেন, যতই আমাকে বকিবেন, ধমকাইবেন আমি কথাটিও বলিব না। কিন্তু আপনি আমার মুথে বিরাশির দশ আনার একটি থাপ্পড় মারিলেও যে আমি কথা বলিব না, এ কথা ত চুক্তিতে ছিল না।’
গ্রামের সমস্ত লোকের কাছে খাঁ সাহেবের মাথা হেঁট হইল।
0 coment�rios: