ব্রহ্মদত্তের আমলে বারাণসীতে এক ব্রাহ্মণ বাস করত। ব্রাহ্মণ ‘বেদব্ভ’ মন্ত্রে সিদ্ধ ছিল। এই মন্ত্রের আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল।। তিথি নক্ষত্র দেখে একটি বিশেষ যোগে এই মন্ত্র পাঠ করে আকাশের দকে তাকালে সাত রকম রত্নের বৃষ্টি হত। বোধিসত্ত্ব লেখাপড়া শেখার জন্য এই ব্রাহ্মণের শিষ্য হন।
একবার বিশেষ দরকারে ব্রাহ্মণকে চেতিচ রাজ্যে যেতে হবে। বোধিসত্ত্বকে সঙ্গে নিয়ে সে রওনা হল। পথে আছে এক গভীর বন। যেতে হলে সেই বনের মধ্য দিয়েিই যেতে হবে। অথচ বনটি মোটেই নিরাপদ নয়। যেখানে ‘প্রেষণক’ নামে একদল ডাকাত থাকে। ডাকাতেরা দলেও ভারি, পাঁচশ। তাদের হামলায় পথিককুলের বিপদের অন্ত ছিল না।
এই ডাকাতদের ‘প্রেষণক’ বলা হত, কারণ তারা দুজন পথিককে ধরলে একজনকে ছেড়ে দিত বাড়ি থেকে মুক্তিপনের টাকা নিয়ে আসতে। বাবা আর ছেলেকে ধরলে তারা মুক্তিপণ আদায়ের জন্য বাবাকে পাঠাত। মা আর মেয়েকে ধরলে পাঠাত মাকে। দু ভাইকে ধরলে মুক্তিপণ আনার ভার পড়ত বড় ভাইয়ের ওপর। গুরু শিষ্যকে ধরলে শিষ্যকে পাঠাত।
ডাকাতের দল ব্রাহ্মণ আর বোধিসত্ত্বকে ধরে ফেলল। নিয়ম অনুসারে তারা বোধিসত্ত্বকে ছেড়ে দিল টাকা আনার জন্য। বোধিসত্ত্ব গুরুকে প্রণাম করে বললেন, ‘দু-একদিনের মধ্যেই আমি ফিরে আসব। আমি যা বলেছি আপনি যদি সেভাবে দুদিন থাকেন তাহলে কোন ভয় নেই। আজ রত্ন বর্ষণের যোগ আছে। কিন্তু সাবধান, ভুলেও এ কাজ করতে যাবেন না। যদি করেন তাহলে আপনি তো মরবেনই, এই পাঁচশ ডাকাতও মারা যাবে।’ গুরুকে প্রণাম করে দিয়ে বোধিসত্ত্ব মুক্তিপণ আনতে রওনা দিলেন।

এদিকে সন্ধা হল। ডাকাতেরা ব্রাহ্মণের হাত পা বেঁধে ফেলে রেখেছে। বনের মাথায় তখন পূর্ণিমার চাঁদ। ব্রাহ্মণ নক্ষত্র দেখে বুঝতে পারল ‘মহাযোগ’ এসে গিয়েছে। সে তখন মনে মনে ভাবল, ‘খামোখা এত কষ্ট করছি কেন? ডাকাতেরা রত্ন পেলেই তো আমাদের ছেড়ে দেবে। মন্ত্র পড়লেই রত্ন পাওয়া যাবে। ডাকাতদের মুক্তিপণ চুকিযে দিয়ে যেখানে খুশি যেতে পারব।’ এই ভেবে সে ডাকাতদের ডেকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা আমাকে বেঁধে রেখেছ কেন?’
‘টাকার জন্য’
‘যদি টাকা পেতে চাও তাহলে এক্ষুণি বাঁধন খুলে দাও। আমাকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পড়াও। চন্দন আর মালায় আমাকে সাজিয়ে দাও। তারপর কিছুক্ষণ একা থাকতে দাও।’
ডাকাতেরা ব্রাহ্মণের কথা শুনল। ব্রাহ্মণ যা যা বলল তারা ঠিক সেভাবে সব কাজই করল। ব্রাহ্মণ মন্ত্র পড়ে আকাশের দিকে তাকাতেই রত্নবৃষ্টি শুরু হল। ডাকাতেরা পুঁটলিতে রত্ন বেঁধে নিয়ে রওনা দিল। ব্রাহ্মণকেও তাদের সঙ্গে নিল।
অবশ্য তাদের বেশি দুরে যেতে হল না। আরেক দল ডাকাত, সংখ্যায় তারাও পাঁচশ, এসে প্রেষণকদের ঘিরে ধরল। প্রথম ডাকাত দল দ্বিতীয় ডাকাত দলকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা আমাদের বন্দী করছ কেন?’
তারা জবাব দিল, ‘টাকার জন্য।’
তখন প্রথম ডাকাত দল বলল, ‘তাহলে এ ব্রাহ্মণকে ধর, উনি আকাশের দিকে তাকালেই রত্ন বৃষ্টি হয়। আমাদের সঙ্গে যেসব রত্ন দেখছ সব উনিই দিয়েছেন।’
দ্বিতীয় ডাকাত দল তখন ব্রাহ্মণকে ধরল, ‘ আমাদের এক্ষুণি রত্ন দাও।’
ব্রাহ্মণ বলল, ‘দেখ ভাই, রত্ন বৃষ্টি সব সময় হয় না, তার জন্য বিশেষ যোগ আছে। যে যোগে রত্ন বর্ষণ হয় তা ফিরে আসতে আবার এক বছর লাগবে। তোমাদের রত্ন দিতে আমার কোন আপত্তি নেই। তবে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে।’

শুনে ডাকাতদল বেজায় রেগে গিযে বলল, ‘চালাকি করছ! এক্ষুণি তুমি প্রেষণকদের রত্ন দিলে, আর আমাদের বেলায় এক বছর অপেক্ষা করতে বলছ?’ সঙ্গে সঙ্গে তারা ব্রাহ্মণকে দু টুকরো করে ফেলল। তারপর আক্রমণ করল প্রেষণকদের। প্রেষণকরা মারা গেলে রত্ন নিযে তাদের নিজেদেরই মধ্যেই যুদ্ধ লাগল। মারামারি কাটাকাটি করে দুজন ছাড়া সবাই মারা গেল।
ঐ দুজন ডাকাত তখন গ্রামের কাছাকাছি এক জঙ্গলে রত্নগুলো লুকিয়ে রাখল। দুজনরেই খুব খিদে পেয়েছে। এক ডাকাত রত্ন পাহারা দিতে লাগল। আরেক ডাকাত চাল কিনে এনে রান্না চাপাল। রত্ন পাহারা দিচ্ছিল যে সে ভাবল আরেকজনকে শেষ করলে সে অনেক টাকার মালিক হবে। তািই তলোয়ার হাতে নিয়ে তৈরী থাকল, দ্বিতীয় জন ভাত রান্না করে আসা মাত্র তাকে মেরে ফেলবে। দ্বিতীয় ডাকাতও একই কথা ভাবছিল। সে নিজের খাওয়া শেষ করে অপর জনের ভাতে বিষ মিশিয়ে এল্ ফল যা হবার তাই হল। দুজনেই মরে পড়ে রইল।
বোধিসত্ত্ব ফিরে এসে সব কিছু দেখলেন। গুরুকে দাহ করলেন। আর মনে মানে ভাবলেন, ‘নিজের স্বার্থে যা খুশি তাই করলে এ রকমটাই হয়।’
0 coment�rios: