প্রায় পাঁচশত বছর আগের কথা। সে সময় জাতিভেদ, বর্ণভেদ সমাজকে কুলষিত করেছিল। সমাজের এই জাতিভেদ দূর করে সমাজের কলুষমুক্ত করতে, ধর্মীয় গোঁড়ামি ভেঙে দিতে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সহজ করে দিলেন শ্রীগৌরাঙ্গ। এই শ্রীগৌরাঙ্গ বা শ্রীগৌরসুন্দরই শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু। তাঁর সহচর ছিলেন শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু। আরও ছিলেন-শ্রীঅদ্বৈত আচার্য, শ্রীহরিদাস, শ্রীরূপ, শ্রীসনাতন, শ্রীজীব, শ্রীগোপাল ভট্ট, শ্রীরঘুনাথ দাস প্রমুখ।
শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু বললেন, কৃষ্ণনাম কর। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে হরিনাম বিলাও, শ্রীনিত্যানন্দ মেতে উঠলেন কৃষ্ণনাম সংকীর্তনে। যাকে পান, তাকেই বলেন কৃষ্ণনামের কথা, ভজনের কথা।
যে- সময় নবদ্বীপে জগাই-মাধাই নামে দুই যুবক বাস করত। তারা ব্রাহ্মণ সন্তান হয়েও সব সময় পাপকাজে মত্ত ছিল। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে মানুষের প্রতি অত্যচার করাই ছিল তাদের নিত্য দিনের কাজ। তাদের অত্যাচারে নবদ্বীপের লোক অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। জগাই মাধাইয়ের এমম দুরবস্থা দেখে নিত্যানন্দের প্রাণ কেঁদে উঠল। করুণায় তার মন গলে গেল। তিনি তাঁর সঙ্গী সাথীদের নিয়ে জগাই মাধাইয়ের বাড়ির কাছে গিয়ে কীর্তন শুরু করলেন--
বল কৃষ্ণ ভজ কৃষ্ণ কহ কৃষ্ণ নাম।
কৃষ্ণ মাতা কৃষ্ণ পিতা কৃষ্ণ ধন প্রাণ।
তোমা সব লাগিয়া কৃষ্ণের অবতার।
হেন কৃষ্ণ ভজ সবে ছাড় অনাচার।।
সারারাত মদ্যপান করে জগাই-মাধাই সেই সময় দিবানিন্দ্রায় মগ্ন ছিল। কীর্তনের শব্দে তাদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। জগাই-মাধাই বাইরে বেরিয়ে এল। নিত্যানন্দের মুখে হরিনাম শুনে দুইভাই ভীষণ খেপে গেল। তাদের অবস্থা দেখে নিত্যানন্দের হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে গেল। তাঁর দুচোখে অবিরল ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। তিনি ‘হরিবোল’ ‘হরিবোল’ বলে কেঁদে উঠলেন।
নিত্যানন্দের এহেন অবস্থা দেখে জগাই-মাধাইয়ের মন মোটেই নরম হলো না, বরং তারা ক্রোধে জ্বলে উঠল। মাধাই একটি কলসির কানা নিযে নিত্যানন্দের মাথায় আঘাত করল। নিত্যানন্দের কপাল কেটে রক্ত ঝরতে লাগল। সে অবস্থাতেও তিনি হরিনাম করতে লাগলেন। যেন তাঁর কিছুই হয়নি। এমনি ভাবে তিনি মাধাইকে বললেন,
“মেরেছিস বেশ করেছিস, তবু মুখে একবার হরিনাম বল ভাই”
এ সংবাদ শোনার পর গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর শিষ্যগণসহ সেখানে উপস্থিত হলেন। নিত্যানন্দের ঐ রক্তাক্ত অবস্থা দেখে তিনি ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলেন। নিত্যানন্দ মহাপ্রভুকে নিরস্ত করলেন। তিনি শান্ত হলেন।
এ ঘটনায় অনুতপ্ত হয়ে জগাই-মাধাই শ্রীগৌরাঙ্গের চরণে লুটিয়ে পড়ে। তখন শ্রীগৌরাঙ্গ সহাস্যে বললেন জগাইকে আমি ক্ষমা করতে পারি। কিন্তু মাধাই তো নিত্যানন্দের নিকট অপরাধী। আমার ভক্তকে যে কষ্ট দেয় আমি তাদের ক্ষমা করতে পারি না।
তখন নিত্যানন্দ গদগদ কন্ঠে মহাপ্রভুকে বললেন, ‘আমি জানি তুমি এই দুটি জীবকে উদ্ধার করবে। তবু আমার গৌরব বাড়ানোর জন্যই আমার অনুমতির কথা বলছ। তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক, আমি মাধাইকে ক্ষমা করলাম।’ এই বলে নিত্যানন্দ মাধাইকে আলিঙ্গন করলেন, শ্রীগৌরাঙ্গ তখন জগাইকে বুকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করলেন। ভক্তগণ সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘হরিবোল’ ‘হরিবোল’।
এ ঘটনার পর জগাই-মাধাই হয়ে গেল নতুন মানুষ্ কৃষ্ণ, কৃষ্ণ বলতে বলতে তাদের নয়নে অশ্রু ঝরে। এমনি বড় সাধত হয়ে গেল জগাই-মাধাই। শ্রীনিত্যানন্দের এ ক্ষমাই জগাই-মাধাইকে সাধকে পরিনত করেছিল। এটাই ক্ষমার আদর্শ।

শিক্ষা: ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ। ক্ষমা দ্বারা অসৎ মানুষকে সৎ এবং দুর্জয় শত্রুকে বশ করা যায়।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে
উত্তর দিনমুছুন