রহিম শেখ বড়ই রাগী মানুষ। কোন কাজে একটু এদিক-ওদিক হইলেই সে তার বউকে ধরিয়া বেধম মারে। রোজ তাদের বাড়িতে মারামারি লাগিয়াই আছে। সেদিনের একটি ঘটনা বলিতেছি।
বউ সকালে উঠিয়া ঘর-দোর ঝাঁট দিতেছে, রহিম ঘুম হইতে উঠিয়া বলিল “আমার হুঁক্কায় পানি ভরিয়াছ?” বউ বলিল, “তুমি তো ঘুমাইতেছিলে, তাই হুঁক্কায় পানি ভরি নাই। এই এখনই ভরিয়া দিতেছি”। রহিম চোখ গরম করিয়া বলিল, “এতো বেলা হইয়াছে, তবু হুক্কায় পানি ভর নাই! দাঁড়াও দেখাইতেছি তোমায় মজাটা”। এই বলিয়া সে যখন বউকে মারিতে উঠিয়াছে, বউ বলিল, “যখন তখন তুমি আমাকে মার-ধর কর, আমি কিছুই বলি না। জান আমরা মেয়ে জাত? আটকলা হেকমত আমাদের মনে মনে। ফের যদি মার তবে আটকলা হেকমত দেখাইয়া দিব”।
এই কথা শুনিয়া রহিম শেখের রাগ আরো বাড়িয়া গেল। সেএকটা লাঠি লইয়া বউকে মারিতে মারিতে বলিল, “ওরে শয়তানী, দেখি তোর আটকলা কেমন? তুই কি ভবিয়াছিস্ আমি তোর আটকলাকে ডরাই ?”
বহুক্ষণ বউকে মারিয়া রহিম মাঠের কাজ করিতে বাহির হইয়া গেল। অনেক্ষণ কাঁদিয়া কাঁদিয়া বউ মনে মনে একটি মতলব আটিল। বউ-সোয়ামীর ঝগড়া সহজেই মিটিয়া যায়। দুপুরে রহিম বাড়ি আসিলে বউ রহিমের কাছে জানিয়া লইল, কাল সে কোন ক্ষেতে হাল বাহিবে। বিকাল হইলে বউ বাড়ির কাছের এক জেলেকে ডাকিয়া আনিয়া বলির? “জেলে ভাই! কাল ভোর হওয়ার কিছু আহে তুমি আমাকে একটি তাজা শোলমাছ আনিয়া দিবে। আমি তোমাকে এক টাকা আগাম দিলাম। আরও যদি লাগে তাও দিব। শেষ রাতে আমি জাগিয়া খিরকির দরজার সামনে দাড়াইয়া থাকিব। তখন তুমি গোপনে শোল মাছ আমাকে দিয়া যাইবে”।পাড়াগাঁয়ে একটি শোল মাছের দাম বড় জোর আট আনা। এক টাকা পাইয়া জেলে মনের খুশীতে বাড়ি ফিরিল। সে এ-পুকুরে জাল ফেলে ও পুকুরে জাল ফেলে। কত টেংরা, পুঁটি, পাবদা মাছ আটকায়; কিন্তু শোলমাছ আর আটকায় না। রাত যখন শেষ হইয়া আসিয়াছে তখন সত্যি সত্যি একটি শোলমাছ তার জালে ধরা পড়িল। তাড়াতারি মনে খুশীতে সে মাছটি লইয়া রহিম শেখের বাড়ির খিড়কি-দরজায় আসিল। বউ ত আগেই সেখানে আসিয়া দাঁড়াইয়া আছে। মাছটি লইয়া বউ তারতাড়ি যে খেতে রহিম আজ লাঙল বাহিবে সেখানে পুতিয়া রাখিয়া আসিল।
সকাল হইলে রহিম খেতে আসিয়া লাঙল জুড়িল। সে এদিক হইতে লাঙল ফড়িয়া দিয়া ও দিকে যায়, ও দিক হইতে এদিকে আসে। হঠাৎ তাহার লঙলের তলা হইতেএকটি শোল মাছ লাফইয়া উঠিল। রহিম আশ্চর্য হইয়া মাছটি ধরিয়া লইয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিল। তারপর বউকে বলির, “লাঙলের তলায় এই তাহা শোলমাছটি পাইলাম । খোদার কি কুদরত! এই মাছের কিছুট ভাজা করিবে, আর কিছুটা তরকারি করিবে। অনেকদিন মাছ ভাত খাই না। আজ পেট ভরিয়া মাছ ভাত খাইব”। এ্ বিলিয়া রহিম ক্ষেতের কাজে চালিয়া গেল। দুপুর হইতে না হইতেই বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া সে বউ এর কাছে খাইতে চাহিল। বউ এক থাল ভাত আর কয়েকটা মরিচ পোড়া আনিয়া তাহার সামনে ধরিল।
একে তো ক্ষুধায় তাহার শরীরে আগুন উঠিয়াছে, তাহার উপর এই মরিচ পোড়া আর ভাত দেখিয়া রহিমের মাথায় খুন চাপিয়া গেল। সে চোখ গরম করিয়া বলির, “সেই শোল মাছ কি করিয়াছিস্ শীগ্গীর বল?” বউ যেন আকাশ হইতে পড়িল, এমনি ভাব দেখাইয়া বলিল, “কই, মাছ কোথায়? তুমি কি আজ বাজার হইতে মাছ কিনিয়াছ?
রহিম বলির, “কেন, আমি যে আজ ইটা ক্ষেত হইতে শোলমাছটা ধরিয়া আনিলাম”। বউ উত্তর করিলম “বল কি? ইটা ক্ষেতে কেহ কখনো শোল মাছ ধরিতে পারে? কখন তুমি আমাকে শোল মাছ আনিয়া দিলে? তোমার কি মাথা খারাপ হইয়াছে?”
তখন রহিমের মাথা দাউ দাউ করিতেছে। সে চিৎকার করিয়া উঠিল, “ওরে শয়তানী! এমন মাছটা তুই নিজে রাধিয়া খাইয়া আমার জন্য রাখিয়াছিস্ মরিচ-পোড়া আর ভাল! দেখাই তোর মজাটা”। এই বলিয়া রহিম বউকে বেদম প্রহার করিতে লাগিল।বউ চিৎকার করিয়া সমস্ত পাড়ার লোক জড় করিয়া ফেলির, “ওরে তোমরা দেখরে, আমার সোয়ামী পাগল ইয়াছে, আমাকে মারিয়া ফেলিল”।
বউ এর চিৎকার শুনিয়া এ পাড়া ও পাড়া হইতে বহুলোক আসিয়া জড় হইল। তাহার জিজ্ঞাসা করিল, “তোমরা এতো চেঁচামেচি করিতেছ কেন?” তোমাদের কি হইছে? রহিম বলির, “দেখ ভাই সকলরা, আজ আমি একটা তাজ শোলমাছ বলিয়া আনিয়া বউকে দিলাম পাক করিতে। এই রাক্ষসী সেটা নিজেই খাইয়া ফেলিয়াছে। আর আমার থালায় রাখিয়াছে এই মরিচ-পোড়া আর ভাত। আপনারাই বিচার করেন এখন বউ এর কি শাস্তি হইতে পারে?”
বউ তখন হাত জোর করিয়া বলিল, “দোহাই আপনাদের সকলের। আপনারা ভাল মত পরীক্ষা করিয়া দেখেন আমার সোয়ামীর মাথা খারপ হইয়া সে যা’তা’ বলিতেছে কিন? ওর কাছে আপনারা জিজ্ঞাসা করেন, ও কোথা হইতে মাছ আনিল, আর কখন আনিল?”
রহিম বলিল, “আজ সকালে ঐ ইটাক্ষেতে যখন লাঙল দিতেছিলাম তখন একটি এত বড় শোলমাছ আমার লাঙলের তলে লাফাইয়া উঠিয়াছিল। সেইটি ধরিয়া আনিয়া বউকে পাক করিতে দিয়াছিলাম”।
বউ পাড়ার সবাইকে বলির. “আপনারা সবাই বলুন, শুকনা মাঠে তাজা শোলমাছ কেমন করিয়া আসিবে? আমার সোয়ামী পাগল না হইলে এমন কথা বলিতে পারে”।
গায়ের লোকেরা সকলেই বলাবলি করিল, “রহিম শেখের ইটাক্ষেতের ধারে পারে কোন ইদারা-পুকুর নাই। সেখানে শোলমাছ আসিকে কোথা হইতে? রহিম পাগল হইয়াছে”। তথন তাহারা পরামিশ করিয়া রহিমকে দড়ি দিয়া বধিতে গেল। সে যখন বাধা দিতেছিল, সকলে তখন তাহাকে কিল-থাপর মারিতেছিল। একজন বলিল, “পানিতে চুবাইলে পাগলের পাগলামী সারে। চল ভাই, একে পুকুরে লইয়া গিয়া কিছুটা চুবাইয়া আনি”। যেই কথা সেই কাজ। সকলে ধরিয়া রহিমকে পুকুরে লইয়া গিয়া চুবাইতে লাগিল। রহিম বাধা দিল। কার বাধা কে মানে। সে যতই বাধা দেয়, তাহার তাকে ততই চুবায়। চুবাইতে চুবাইতে আধসরা করিয়া রহিমকে তাহার ঘরে লইয়া আসিল। রহিম রাগে শোষাইতে লাগিল। তখন একজন বলির, “ উহাকে আজই পাগলা গারদে লইয়া যায়। নতুবা রাগের মাথায় কাকে খুন করিয়া ফেলে বলা যায় না”।

রহিমের বউ বলির, “আপনারা আজকের মতো ওকে ঘরের খামের সাথে বাধিয়া রাখিয়া যান। কাল যদি না সারে পাগলা গারদে লইয়া যাইবেন”।
গায়ের লোক তাহাই করিল। রহিমকে ঘরের একটি খামের সাথে কষিয়া বাধিয়া যে যার বাড়ি চলে গেল।
সবলোক চালিয়া গেলে বউ রহিমের হাতের পায়ের বাধন খুলিয়া দিয়া হাসিতে হাসিতে মাছ ভাতের থালা আনিয়া তাহার সামনে ধরিল। গরম গরম পাক করা মাছের তরকারির গন্ধ সারাদিন না খাওয়া রহিমের নাকে আসিয়া লাগিল। সে মাথা নিচু করিয়া ভাত খাইতে শুরু করিল। পাখার বাতাস করিতে করিতে বউ বলিল, “দেখ, আমরা মেয়ে জাত আটকলা বিদ্য জানি; তারই এক কলা আজ তোমাকে দেখাইলাম। তাতেই এক কান্ড আর বাকিসাত কলা দেখাইলে কি যে হইত বুঝিতে পার”।
রহিম বলিল, “দোহাই তোমার আর সাতকলার ভয় দেখাইয় না। এই আমি কছম কাটিলাম। এখন হইতে আর যদি তোমার গায়ে হাত তুলি তখন যাহা হয় করিয়”।
0 coment�rios: