‘সহজে কি বড়লোক হওয়া যায়’ এই নামের প্রস্তাবটি শেষ করিবার সময় আমরা গিরিশের পরে কি হইল, তৎসম্বন্ধে কিছু বলিতে প্রতিশ্রুত হইয়াছিলাম। কিন্ত গিরিশের জীবনে এত কষ্ট সহ্য করিতে হইয়ছিল যে আমরা সে-সব বলিতেও কষ্ট বোধ করি। তবে এইমাত্র বলা আবশ্যক যে, বেচারা কোন দিনই বড়লোক হইতে পারে নাই। দুঃখ কষ্টের একশেষ তাহার জীবন হইয়াছিল। পরিশেষে সে নিজের হাতে নিজের জীবন শেষ করিয়া দিল।
গিরিশেস সম্বন্ধে যে-সকল কথা বলা হইয়াছে, মোটামুটি সকলগুলিই সত্য। কথাগুলি যথার্থ বলিয়াই সেগুলি এত গুরুতর। তাহার ভাগ্যে যাহা ঘটিয়াছিল,আমরা যদি তাহার মতন কাজ করি, কে জানে, কোন দিন আমাদের সম্বন্ধেও কেউ এইরূপ গল্পসকল বলিয়া লোককে সাবধান করিবে না। পরে কষ্ট পাওয়ার চাইতে আগে সতর্ক হওয়া ভাল।
বড়লোক হওয়ার ইচ্ছা থাকিলেই কিন্ত বড়লোক হয় না; তাহা হইলে অত কম লোক বড়লোক হইতে দেখিতাম না। ইচ্ছা ত সকলেরই আছে, তোমার আমার নাই? কিন্ত আমি তো আজিও ছোটলোকই রহিয়াছি! শুধু ইচ্ছা থাকিলেই বড়লোক হয় না; ইচ্ছার খুব দরকার, কিন্ত আরো কিছু চাই। গিরিশের ইচ্ছা যথেষ্ট ছিল। তাহার পক্ষে যতটুকু কুলাইয়াছিল, সে ত চেষ্টার ত্রুটি করে নাই। কিন্ত তবুও সে বড়লোক হইল না! হইবে কেমন করিয়া? কিরূপে কেমন করিয়া কি করিতে হইবে তাহা যদি না জানিলাম, তবে ত সেই গাধা রামকন্তের মতই রহিলাম। রাম কাসে একদিনও উপরে উঠিতে পারিল না, নীচে নামিবারও জায়গা ছিল না গুরু মহাশয় তাহাকে তিরস্কার করিয়া বলিতেন, ‘ ওরে তোর আর কি কিছু হবে! ভাল ছেলে হ’তে হ’লে তেল পোড়াতে হয়, খাটতে হয়, কষ্ট সহ্য করতে হয়!’ রামকান্ত একদিন বাড়ি আসিয়াই দু সের তেল কিনিয়া আনিল। ঐ তেলে কাপড় ভিজাইয়া তাহাতে আগুন লাগাইয়া দিল। তারপর ঘরের চালে দড়ি বাঁধিয়া তাহাতে প্রাণপণে দুলিতে লাগিল। সর্বশেষে দড়ি ছিঁড়িয়া আগুনের উপর অর্ধ দগ্ধ, অর্ধ ভগ্ন শরীরে নিস্কৃতি পাইল। যে দুই সপ্তাহ শয্যাগত থাকিতে হইয়াছিল, তাহার মধ্যে অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া ঠিক করিল, মাষ্টার মহাশয় ভুল করিয়াছেন।
সে সরল লোক, যেদিন স্কুলে গেল সেদিনই মাস্টার মহাশয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে তর্ক করিল। রামকান্তের যে ভুল, গিরিশ বেচারারও সেই ভুল। ভাই, আমরা যে বড়লোক হই না, আমাদেরও অনেকের সেই ভুল। যদি বড়লোক হইতে ইচ্ছা থাকে-‘নাই’ যদি বল তবে আমি হাসিব-তবে প্রথমে কি কি কাজ করিলে বড়লোক হয়, বেশ করিয়া জান। তারপর নিঃশব্দে শান্তভাবে আপন কার্যে প্রবৃত্ত হও। অনেক কষ্ট পাইতে হইবে; তাহার জন্য যথেষ্ট সহিষ্ণুতা চাই। অনেক সুখ পায়ে ঠেলিতে হইবে; তাহার জন্য সমুচিত ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন। এত করিয়াও কত জন উপযুক্ত বুদ্ধির অভাবে বড় হইতে পারিতেছে না। তুমিও পারিবে কি না জানি না-আমি ইচ্ছা করিতেছি তোমরা সকলেই পারিবে।-কিন্ত ইহা বলিতে পারি যে তোমার পক্ষে যতটুকু হওয়া সম্ভব, তাহা হইতে গেলেই আমি যাহা বলিলাম সব কয়টি করিতে হইবে।
বড়লোক, বড়লোক, এতবার বলিলাম। কিন্ত কতজন বড়লোক হইতে চাহিতেছেন, সকলেই কি বুঝিতে পারিতেছেন যে বড়লোক হওয়ার অর্থ কি? একটা লোক বলিতেছিল যে, ‘আমার ছেলের বিবাহেতে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়াছি।’ তাহাকে জিজ্ঞাসা করা হইল, ‘বল ত দেখি লাখ টাকার কথা বলা বলিলে কতগুলি টাকার কথা বলা হয়?’ সে বলিল কেন, ‘কেন, লাক টাকা আর লাক টাকা, দুকুড়ি দশ টাকা।’ বড়লোক হওয়া সম্বন্ধেও অনেকের ঐরূপ মত। অনেকের কেবল নিজের বেলাই ঐ মত। তাহারা বড় ছোট লোক। ভাই, বড়লোক না হও দুঃখ নাই; কিন্ত ছোট লোক হইও না।
কোন ভাল বিষয়ে খুব ভাল হইলে বড়লোক হয়। যেমন বিদ্যাসাগর মহাশয় বড়লোক, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বড়লোক, লর্ড রিপন বড়লোক, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার বড়লোক, সুরেন্দ্র বাবু বড়লোক, ইত্যাদি, ইঁহাদের সকলেই এক বিষয়ের জন্য বড় হন নাই। কিন্ত একটু চিন্তা করিলেই দেখিবে, ইঁহাদের যাঁহার মধ্যে যেটুকু ভাল তাহার জন্যই তাঁহাকে বড়লোক বলা হয়। বড় চোরকেও বড়লোক বলা হয় না, বড় ডাকাতকেও বড়লোক বলা হয় না।
আর এক কথা। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিদ্যার জন্য আমরা তাঁহাকে অত বড়লোক বলি না। মহেন্দ্র বাবু নিজের ঘরে কবাট দিয়া বিজ্ঞান চর্চা করিলে আমরা তাঁহাকে অত বড়লোক বলিতাম না, অন্তত তাঁহার প্রতি আমাদের অত শ্রদ্ধা হইত না। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, লর্ড রিপন, ইঁহারা কে কি শাস্ত্র অধিক জানেন, কি কিছুই জানেন না, তাহার হিসাবও হয়ত আমরা কেহ দিতে পারিব না। সুরেন্দ্র বাবুর স্কুল আছে, সেখানে তিনি পড়ান, এজন্য তাঁহাকে কেহ বড়লোক বলে না। যিনি যে পরিমানে লোকের উপকার করিতেছেন, তিনি সেই পরিমানে লোকের ভালবাসা পাইতেছেন। বড়লোক এবং ভাল লোক, এ উভয়ই যথার্থ বড়লোক। বড়লোক হওয়া যেরূপই কঠিন হউক না কেন, ভাল লোক চেষ্টা করিলেই হওয়া যায়। এবং তাহাই আগে হওয়া উচিত। কাহারো যদি এক কোটি টাকা থাকে, তাঁহাকে সুদ্ধ ঐ টাকাগুলির জন্য বড়লোক বলিব না। তিনি নিজের সদ্গুনের সাহায্যে উহা উপার্জন করিয়া থাকিলে অবশ্য তাঁহাকে বড়লোক বলিব। কিন্ত যখন দেখি ঐ টাকা দিয়া দেশের উপকার করিতেছেন, তখনই তাঁহাকে যথার্থ বড়লোক বলিব। কারণ, তখন তিনি বড়লোক এবং ভাল লোক উভয়ই হইয়াছেন। বড়লোক বড়, ভাল লোক ভাল, বড়লোক ভাল হইলে বড় ভাল।
‘সহজে কি বড়লোক হওয়া যায়’ এই নামের প্রস্তাবটি শেষ করিবার সময় আমরা গিরিশের পরে কি হইল, তৎসম্বন্ধে কিছু বলিতে প্রতিশ্রুত হইয়াছিলাম। কিন্ত ...
বড়লোক কিসে হয়? উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
Share This
About author: Sisir Suvro
Cress arugula peanut tigernut wattle seed kombu parsnip. Lotus root mung bean arugula tigernut horseradish endive yarrow gourd. Radicchio cress avocado garlic quandong collard greens.
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 coment�rios: