ড্রাকুলা - ব্রাম স্টোকার (রূপান্তর : রকিব হাসান) || পর্ব-০১
এক
চামচিকে আর টিকিট চেকার - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
—বুঝলি প্যালা, চামচিকে ভীষণ ডেঞ্জারাস!...
একটা ফুটাে শাল পাতায় করে পটলডাঙার টেনিদা ঘুগনি খাচ্ছিল। শালপাতার তলা দিয়ে হাতে খানিক ঘুগনির রস পড়েছিল, চট করে সেটা চেটে নিয়ে পাতাটা তালগোল পাকিয়ে ছুঁড়ে দিলে ক্যাবলার নাকের ওপর। তারপর আবার বললে, হুঁ হুঁ, ভীষণ ডেঞ্জারাস চামচিকে।
—কী কইর্যা বোঝলা—কও দেখি?—
বিশুদ্ধ ঢাকাই ভাষায় জানতে চাইল হাবুল সেন।
—আচ্ছা, বল চামচিকের ইংরেজি কি?
আমি, ক্যাবলা আর হাবুল সেন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম।
—বল না!
শেষকালে ভেবে-চিন্তে ক্যাবলা বললে, স্মল ব্যাট। মানে ছােট বাদুড়!
—তোর মুণ্ডু।
—আমি বললাম, তবে ব্যাটলেট। তা-ও নয়? তা হলে? ব্যাটস সান—মানে, বাদুড়ের ছেলে? হল না? আচ্ছা, ব্রিক ব্যাট কাকে বলে?
টেনিদা বললে থাম উল্লুক! ব্রিক ব্যাট হল থান ইট! এবার তাই একটা তোর মাথায় ভাঙব।
হাবুল সেন গভীর মুখে বললে, হইছে।
—কী হল?
—স্কিন মোল।
—স্কিন মোল?...টেনিদা খাঁড়ার মতো নাকটাকে মনুমেন্টের মতো উঁচু করে ধরল, সে আবার কী?
—স্কিন মনে হইল চাম— অর্থাৎ কিনা চামড়া। আর আমাগো দ্যাশে ছুঁচারে কয় চিকা— মোল। দুইটা মিলাইয়া স্কিন মোল।
টেনিদা খেপে গেল : দ্যাখা হাবুল, ইয়ার্কির একটা মাত্রা আছে, বুঝলি? স্কিন মোল। ইঃ—গবেষণার দৌড়টা দেখ একবার।
আমি বললাম, চামচিকের ইংরেজী কী তা নিয়ে আমাদের জ্বালাচ্ছ কেন? ডিক্সনারি দ্যাখো গে!
—ডিক্সনারিতেও নেই। —টেনিদা জয়ের হাসি হাসল।
—তা হলে?
—তা হলে এইটাই প্রমাণ হল চামচিকে কী ভীষণ জিনিস। অর্থাৎ এমন ভয়ানক যে চামচিকাকে সাহেবরাও ভয় পায়! মনে কর না— যারা আফ্রিকার জঙ্গলে গিয়ে সিংহ আর গরিলা মারে, যারা যুদ্ধে গিয়ে দমদম বোমা আর কামান ছোড়ে, তারা সুদ্ধ চামচিকের নাম করতে ভয় পায়। আমি নিজের চোখেই সেই ভীষণ ব্যাপারটা দেখেছি।
কী ভীষণ ব্যাপার?—গল্পের গন্ধে আমরা তিনজনে টেনিদাকে চেপে ধরলাম: বলো এক্ষুনি।
—ক্যাবলা, তাহলে চটপট যা। গলির মোড় থেকে আরও দুআনার পাঁঠার ঘুগনি নিয়ে আয়। রসদ না হলে গল্প জমবে না।
ব্যাজার মুখে ক্যাবলা ঘুগনি আনতে গেল। দু’আনার ঘুগনি একাই সবটা চেটেপুটে খেয়ে, মানে আমাদের এক ফোঁটাও ভাগ না দিয়ে, টেনিদা শুরু করলে : তবে শোন—
সেবার পাটনায় গেছি ছোটমামার ওখানে বেড়াতে। ছোটমামা রেলে চাকরি করে— আসার সময় আমাকে বিনা টিকিটেই তুলে দিলে দিল্লি এক্সপ্রেসে। বললে, গাড়িতে চ্যাটার্জি যাচ্ছে ইনচার্জ— আমার বন্ধু। কোনও ভাবনা নেই-সেই-ই তোকে হাওড়া স্টেশনের গেট পর্যন্ত পার করে দেবে!
নিশ্চিন্ত মনে আমি একটা ফাঁকা সেকেন্ড ক্লাস কামরায় চড়ে লম্বা হয়ে পড়লাম।
শীতের রাত। তার ওপর পশ্চিমের ঠাণ্ডা— হাড়ে পর্যন্ত কাঁপুনি ধরায়।
কিন্তু কে জানত— সেদিন হঠাৎ মাঝপথেই চ্যাটার্জির ডিউটি বদলে যাবে। আর তার জায়গায় আসবে—কী নাম ওর— মিস্টার রাইনোসেরাস।
ক্যাবলা বললে, রাইনোসেরাস মানে গণ্ডার।
—থাম, বেশি বিদ্যে ফলাসনি। ...টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, যেন ডিক্সনারি একেবারে। সায়েবের বাপ-মা যদি ছেলের নাম গণ্ডার রাখে— তাতে তোর কী র্যা? তোর নাম যে কিশলয় কুমার না হয়ে ক্যাবলা হয়েছে, তাতে করে কী ক্ষেতি হয়েছে শুনি?
হাবুল সেন বললে, ছাড়ান দাও— ছাড়ান দাও। পোলাপান!
—হুঁ, পোলাপান! আবার যদি বকবক করে তো জলপান করে ছাড়ব! যাক— শোন। আমি তো বেশ করে গাড়ির দরজা-জানালা এঁটে শুয়ে পড়েছি। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। একে দুখানা - কম্বলে শীত কাটছে না, তার ওপরে আবার খাওয়াটাও হয়ে গেছে বড্ড বেশি। মামাবাড়ির কালিয়ার পাঠাটা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠে গাড়ির তালে তালে পেটের ভেতর শিং দিয়ে ঢুঁ মারছে। লোভে পড়ে অতটা না খেয়ে ফেলেই চলত।
পেট গরম হয়ে গেলেই লোকে নানা রকম দুঃস্বপ্ন দেখে— জানিস তো? আমিও স্বপ্ন দেখতে লাগলাম, আমার পেটের ভেতরে সেই যে বাতাপি না ইল্বল কে একটা ছিল— সেইটে পাঁঠা হয়ে ঢুকেছে। একটা রাক্ষস হিন্দি করে বলছে : এ ইল্বল— আভি ইসকো পেট ফাটাকে নিকাল আও—
—বাপরে— বলে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। চোখ চেয়ে দেখি, গাড়ির ভেতরে বাতাপি বা ইম্বল কেউ নেই-— শুধু ফর-ফর করে একটা চামচিকে উড়ছে। একেবারে বোঁ করে আমার মুখের সামনে দিয়ে উড়ে চলে গেল-নাকটাই খিমচে ধরে আর কি!
এ তো আচ্ছা উৎপাত।
কোন দিক দিয়ে এল কে জানে? চারিদিকে তো দরজা-জানালা সবই বন্ধ। তবে চামচিকের পক্ষে সবই সম্ভব। মানে অসাধ্য কিছু নেই।
একবার ভাবলাম, উঠে। ওটাকে তাড়াই। কিন্তু যা শীত—কম্বল ছেড়ে নড়ে কার সাধ্যি। তা ছাড়া উঠতে গেলে পেট ফুঁড়ে শিং-টিং সুদ্ধু পাঁঠাটাই বেরিয়ে আসবে হয়তো বা। তারপর আবার যখন সাঁ করে নাকের কাছে এল, তখন বসে পড়ে আর কি। আমার খাড়া নাকটা দেখে মনুমেন্টের ডগাই ভাবল বোধ হয়।
আমি বিচ্ছিরি মুখ করে বললাম, ফর-র-ফুস! —মনে চামচিকেটিকে ভয় দেখলাম। তাইতেই আঁতকে গেল কি না কে জানে— সাঁ করে গিয়ে ঝুলে রইল একটা কোট-হ্যাঙ্গারের সঙ্গে। ঠিক মনে হল, ছােট একটা কালো পুটলি ছুলছে!
এত রাত্তিরে কে আবার জ্বালাতে এল? নিশ্চয় কোনও প্যাসেঞ্জার। প্রথমটায় ভাবলাম, পড়ে থাকি ঘাপটি মেরে। যতক্ষণ খুশি খটখটিয়ে কেটে পড়ুক লোকটা। আমি কম্বলের ভেতরে মুখ ঢোকালাম।
কিন্তু কী একটা যাচ্ছেতাই স্টেশনে যে গাড়িটা থেমেছে কে জানে! সেই যে দাঁড়িয়ে আছে—একদম নট নড়ন-চড়ন! যেন নেমন্তন্ন খেতে বসেছে! ওদিকে দরজায় খটখটানি সমানে চলতে লাগল। ভেঙে ফেলে আর কি!
এমন বেয়াক্কেলে লোক তো কখনও দেখিনি! ট্রেনে কি আর কামরা নেই যে এখানে এসে মাথা খুঁড়ে-মরছে! ভারি রাগ হল। দরজা না খুলেও উপায় নেই— রিজার্ভ গাড়ি তো নয় আর। খুব কড়া গলায় হিন্দীতে একটা গালাগাল দেব মনে করে উঠে পড়লাম।
ক্যাবলা হঠাৎ বাঁধা দিয়ে বললে, তুমি মোটেই হিন্দী জানো না টেনিদা!
—মানে।
—তুমি যা বলে তা একেবারেই হিন্দী হয় না। আমি ছেলেবেলা থেকে পশ্চিমে ছিলাম—
—চুপ কর বলছি ক্যাবলা!—টেনিদা। হুঙ্কার ছাড়ল ; ফের যদি ভুল ধরতে এসেছিস তো এক চাঁটিতে তোকে চাপাটি বানিয়ে ফেলব! আমার হিন্দী শুনে বাড়ির ঠাকুর পর্যন্ত ছাপরায় পালিয়ে গেল, তা জানিস?
হাবুল বললে, ছাইড়্যা দাও— চ্যাংড়ার কথা কি ধরতে আছে?
—চ্যাংড়া! চিংড়িমাছের মতো ভেজে খেয়ে ফেলব! আমি বললাম, ওটা অখাদ্য জীব— খেলে পেট কামড়াবে, হজম করতে পারবে না। তার চেয়ে গল্পটা বলে যাও।
—হুঁ, শোন! —টেনিদা ক্যাবলার ছ্যাবলামি দমন করে আবার বলে চলল : উঠে দরজা খুলে যেই বলতে গেছি— এই আপ কেইসা আদমি। হ্যায়— সঙ্গে সঙ্গে গাঁক গাঁক করে আওয়াজ!
—গাঁক—গাঁক?
—মানে সায়েব। মানে টিকিট চেকার।
—সেই রাইনোসেরাস? বকুনি খেয়েও ক্যাবলা সামলাতে পারল না।
—আবার কে? একদম খাঁটি সায়েব-পা থেকে মাথা ইস্তক।
সেই যে একরকম সায়েব আছে না? গায়ের রং মোষের মতো কালো, ঘামলে গা দিয়ে কালি বেরোয়— তাদের দেখলে সায়েবের ওপরে ঘেন্না ধরে যায়— মোটেই সে-রকমটি নয়। চুনকাম করা ফর্সা রঙ— হাঁড়ির মতো মুখ, মোটা নাকের ছাঁদায় বড় বড় লালচে লোম— হাসলে মুখ ভর্তি মুলো দেখা যায়, আর গলার আওয়াজ শুনলে মনে হয় ষাঁড় ডাকছে— একেবারে সেই জিনিসটি! ঢুকেই চোস্ত ইংরেজীতে আমাকে বললে, এই সন্ধেবেলাতেই এমন করে ঘুমোচ্ছ কেন? এইটেই সবচেয়ে বিচ্ছিরি হ্যাবিট।
—কী রকম চোস্ত ইংরেজী টেনিদা? আমি জানতে চাইলাম।
—সে-সব শুনে কী করবি?...টেনিদা উঁচু দরের হাসি হাসল! শুনেও কিছু বুঝতে পারবি না-সায়েবের ইংরেজী কিনা! সে যাক। সায়েবের কথা শুনে আমার তো চোখ কপালে উঠল রাত বারোটাকে বলছে সন্ধেবেলা। তা হলে ওদের রাত্তির হয়। কখন? সকালে নাকি?
তারপরেই সায়েব বললে, তোমার টিকিট কই?
আমার তো তৈরী জবাব ছিলই। বললাম, আমি পাটনার বাঁড়ুজ্যে মশাইয়ের ভাগনে। আমার কথা ক্রু-ইন-চার্জ চাটুজ্যেকে বলা আছে।
তাই শুনে সায়েবটা এমনি দাঁত খিঁচোল যে, মনে হল মুলোর দোকান খুলে বসেছে। নাকের
লোমের ভেতরে যেন ঝড় উঠল, আর বেরিয়ে এল খানিকটা গর-গরে আওয়াজ!
যা বললে, শুনে তো আমার চোখ চড়ক গাছ।
—তােমার বাড়ুজ্যে মামাকে আমি থোরাই পরোয়া করি! এসব ডাবলুটিরা ও-রকম ঢের মামা পাতায়। তা ছাড়া চাটুজ্যের ডিউটি বদল হয়ে গেছে— আমিই এই ট্রেনের ক্রু-ইন-চার্জ। অতএব চালাকি রেখে পাটনা-টু-হাওড়া সেকেন্ড ক্লাস ফেয়ার আর বাড়তি জরিমানা বের করো।
পকেটে সব সুদ্ধ পাঁচটা টাকা আছে— সেকেন্ড ক্লাস দূরে থাক, থার্ড ক্লাসের ভাড়াও হয় না ; সর্ষের ফুল এর আগে দেখিনি— এবার দেখতে পেলাম! আর আমার গা দিয়ে সেই শীতেও দরদর করে সর্ষের তেল পড়তে লাগল।
আমি বলতে গেলাম, দ্যাখো সায়েব—
সায়েব সায়েব বোলো না—আমার নাম মিস্টার রাইনোসেরাস। আমার গণ্ডারের মতো গোঁ। ভাড়া যদি না দাও— হাওড়ায় নেমে তোমায় পুলিশে দেব। ততক্ষণে আমি গাড়িতে চাবি বন্ধ করে রেখে যাচ্ছি।
—কী বলব জানিস প্যালা— আমি পটলডাঙার টেনিরাম— অমন ঢের সায়েব দেখেছি। ইচ্ছে করলেই সায়েবকে ধরে চলতি গাড়ির জানলা দিয়ে ফেলে দিতে পারতাম। কিন্তু আমরা বোষ্টুম— জীবহিংসা করতে নেই, তাই অনেক কষ্টে রাগটা সামলে নিলাম।
হাবুল সেন বলে বসল ; জীবহিংসা কর না, তবে পাঁঠা খাও ক্যান?
—আরে পাঠার কথা আলাদা। ওরা হল অবোলা জীব, বামুনের পেটে গেলে স্বর্গে যায়। পাঁঠা খাওয়া মানেই জীবে দয়া করা! সে যাক। কিন্তু সায়েবকে নিয়ে এখন আমি করি কী? এ তো আচ্ছা প্যাঁচ কষে বসেছে! শেষকালে সত্যিই জেলে যেতে না হয়!
কিন্তু ভগবান ভরসা!
পকেট থেকে একটা ছোট খাতা বের করে সায়েব কী লিখতে যাচ্ছিল পেনসিল দিয়ে হঠাৎ সেই শব্দ—ফর-ফর—ফরাৎ!
চামচিকেটা আবার উড়তে শুরু করেছে। আমার মতোই তো বিনাটিকিটের যাত্রী— চেকার দেখে ভয় পেয়েছে নিশ্চয়।
আর সঙ্গে সঙ্গেই সায়েব ভয়ানক চমকে উঠল। বললে, ওটা কী পাখি? জবাব দিতে যাচ্ছিলাম, চামচিকে— কিন্তু তার আগেই সায়েব হাইমাই করে চেঁচিয়ে উঠল। নাকের দিকে চামচিকের এত নজর কেন কে জানে— ঠিক সায়েবের নাকেই একটা ঝাপটা মেরে চলে গেল।
ওটা কী পাখি? কী বদখত দেখতে - সায়েব কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গেল! চুনকাম-করা মুখটা তার ভয়ে পানসে হয়ে গেছে।
আমি বুঝলাম এই মওক! বললাম, তুমি কি ও-পাখি। কখনও দ্যাখোনি?
—নো—নেভার! আমি মাত্ৰ ছমাস আগে আফ্রিকা থেকে ইণ্ডিয়ায় এসেছি। সিংহ দেখেছি— গণ্ডার দেখেছি— কিন্তু—
সায়েব শেষ করতে পারল না। চামচিকেটা আর একবার পাক খেয়ে গেল। একটু হলেই প্রায় খিমচে ধরেছিল সায়েবের মুখ। বোধহয় ভেবেছিল, ওটা চালকুমড়ো।
সায়েব বললে, মিস্টার— ও কি কামড়ায়?
আমি বললাম, মোক্ষম। ভীষণ বিষাক্ত! এক কামড়েই লোক মারা যায়। এক মিনিটের মধ্যেই।
—হােয়াট! —বলে সায়েব লাফিয়ে উঠল। তারপরে আমার কম্বল ধরে টানাটানি করতে লাগল।
—মিস্টার—প্লিজ—ফর গডস সেক— আমাকে একটা কম্বল দাও।
—তারপর আমি ওর কামড়ে মারা যাই আর কি ৷ ও সব চলবে না! —আমি শক্ত করে কম্বল চেপে রইলাম!
—অ্যাঁ? তা হলে!— বলেই একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল সায়েব। বোঁ করে একেবারে চেন ধরে ঝুলে পড়ল প্ৰাণপণে। তারপর জানলা খুলে দিয়ে গলা ফাটিয়ে চ্যাঁচাতে লাগল। : হেলপ—হেলপ—আর খোলা জানলা পেয়েই সাহেবের কাঁধের ওপর দিয়ে বাইরের অন্ধকারে চামচিকে ভ্যানিস!
সায়েব খানিকক্ষণ। হতভম্ব হয়ে রইল। একটু দম নিয়ে মস্ত একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললে, যাক— স্যামসিকেটা বাইরে চলে গেছে। এখন আর ভয় নেইকী বলে?
আমি বললাম, না, তা নেই। তবে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা দেবার জন্য তৈরি থাকো।
সাহেবের মুখ হাঁ হয়ে গেল : কেন?
—বিনা কারণে চেন টেনেছ— গাড়ি থামল বলে! আর শোনো সায়েব— চামচিকে খুব লক্ষ্মী পাখি। কাউকে কামড়ায় না—কাউকে কিছু বলে না। তুমি রেলের কর্মচারী হয়ে চামচিকে দেখে চেন টেনেছ— এ জন্যে তোমার শুধু ফাইন নয়— চাকুরিও যেতে পারে।
ওদিকে গাড়ি আস্তে আস্তে থেমে আসছে তখন। মিস্টার রাইনােসেরাস কেমন মিটমিট করে তাকাচ্ছে আমার দিকে। ভয়ে এখন প্রায় মিস্টার হেয়ার—মানে খরগোশ হয়ে গেছে।
তারপরই আমার ডান হাত চেপে ধরল দুহাতে। —শোনো মিস্টার, আজ থেকে তুমি আমার বুজুম ফ্রেণ্ড! মানে প্ৰাণের বন্ধু। তোমাকে আমি ফাস্ট ক্লাস সেলুনে নিয়ে যাচ্ছি— দেখবে তোফা ঘুম দেবে। হাওড়ায় নিয়ে গিয়ে কোলনারের ওখানে তোমাকে পেট ভরে খাইয়ে দেব। শুধু গার্ড এলে বলতে হবে, গাড়িতে একটা গুণ্ডা পিস্তল নিয়ে ঢুকেছিল, তাই আমরা চেন টেনেছি। বলো — রাজি?
রাজি না হয়ে আর কী করি! এত করে অনুরোধ করছে যখন।
বিজয়গর্বে হাসলে টেনিদা : যা ক্যাবলা— আর চার পয়সার পাঁঠার ঘুগনি নিয়ে আয়।
ভজহরি ফিল্ম কপোরেশন - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
বউবাজার দিয়ে আসতে আসতে ভীমনাগের দোকানের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে গেল টেনিদা। আর নড়তে চায় না। আমি বললুম, রাস্তার মাঝখানে অমন করে দাঁড়ালে কেন? চলো।
—যেতে হবে? নিতান্তই যেতে হবে? —কাতর দৃষ্টিতে টেনিদা তাকাল আমার দিকে; প্যালা, তোর প্রাণ কি পাষাণে গড়া? ওই দ্যাখ, থরে-থরে সন্দেশ সাজানাে রয়েছে, থালার ওপর সোনালি রঙের রাজভোগ হাতছানি দিয়ে ডাকছে, রসের মধ্যে ডুব-সাঁতার কাটছে রসগোল্লা, পানতো। প্যালা রে—
আমি মাথা নেড়ে বললুম, চালাকি চলবে না। আমার পকেটে তিনটে টাকা আছে, ছোটমামার জন্যে মকরধ্বজ কিনতে হবে। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে, চলো এখন—
খিদে পেয়েছে রে! আচ্ছা, দুটো টাকা আমায় ধার দে, বিকেলে না হয় ছোটমামার জন্যে মকরধ্বজ—
কিন্তু ও সব কথায় ভােলবার বান্দা প্যালারাম বাড়ুজ্যে নয়। টেনিদাকে টাকা ধার দিলে সে-টাকাটা আদায় করতে পারে এমন খলিফা লোক দুনিয়ায় জন্মায়নি। পকেটটা শক্ত করে ঢেকে ধরে আমি বললুম, খাবারের দোকান চোখে পড়লেই তোমার পেট চাঁই-চাঁই করে ওঠে— ওতে আমার সিমপ্যাথি নেই। তা ছাড়া, এ-বেলা মকরধ্বজ না নিয়ে গেলে আমার ছেঁড়া কানটা সেলাই করে দেবে কে? তুমি?
রেলগাড়ির ইঞ্জিনের মতো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল টেনিদা। —ব্রাহ্মণকে সক্কিলবেলা দাগ দিলি প্যালা— মরে তুই নরকে যাবি।
—যাই তো যাব। কিন্তু ছোটমামার কানমলা যে নরকের চাইতে ঢের মারাত্মক সেটা জানা আছে আমার। আর, কী আমার ব্ৰাহ্মণ রে! দেলখোসা রেস্তোরাঁয় বসে আস্ত-আস্ত মুরগির ঠ্যাং চিবুতে তোমায় যেন দেখিনি আমি!
—উঃ! সংসারটাই মরীচিকা-ভীমানাগের দোকানের দিকে তাকিয়ে শেষবার দৃষ্টিভোজন করে নিলে টেনিদা; নাঃ, বড়লোক না হলে আর সুখ নেই।
বিকেলে চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে সেই কথাই হচ্ছিল। ক্যাবলা গেছে কাকার সঙ্গে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে, হাবুল সেন গেছে দাঁত তুলতে। কাজেই আছি আমরা দুজন। মনের দুঃখে দুঠোঙা তেলেভাজা খেয়ে ফেলেছে টেনিদা। অবশ্য পয়সাটা আমিই দিয়েছি। এবং আধখানা আলুর চাপ ছাড়া আর কিছুই আমার বরাতে জোটেনি।
আমার পাঞ্জাবি আস্তিনটা টেনে নিয়ে টেনিদা মুখটা মুছে ফেলল। তারপর বললে, বুঝলি প্যালা, বড়লোক না হলে সত্যিই আর চলছে না।
—বেশ তো হয়ে যাও-না। বড়লোক— আমি উৎসাহ দিলুম।
—হয়ে যাও-না! —বড়লোক হওয়াটা একেবারে মুখের কথা কিনা! টাকা দেবে কে, শুনি? তুই দিবি?— টেনিদা ভেংচি কাটল। আমি মাথা নেড়ে জানালুম, না আমি দেব না।
—তবে?
—লটারির টিকিট কেনো। — আমি উপদেশ দিলুম।
—ধ্যাত্তোর লটারির টিকিট! কিনে-কিনে হয়রান হয়ে গেলুম, একটা ফুটো পয়সাও যদি জুটত কোনও বার! লাভের মধ্যে টিকিটের জন্যে বাজারের পয়সা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লুম, বড়দা দুটো অ্যায়সা থাপ্পড় কষিয়ে দিলে। ওতে হবে না—বুঝলি? বিজনেস করতে হবে।
—বিজনেস!
—আলবাত বিজনেস। —টেনিদার মুখ সংকল্পে কঠোর হয়ে উঠল; ওই যে কী বলে, হিতোপদেশে লেখা আছে না, বাণিজ্যে বসতে ইয়ে— মানে লক্ষ্মী! ব্যবসা ছাড়া পথ নেই— বুঝেছিস?
—তা তো বুঝেছি। কিন্তু তাতেও তো টাকা চাই।
—এমন বিজনেস করবে। যে নিজের একটা পয়সাও খরচ হবে না। সব পরস্মৈপদী— মানে পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে।
—সে আবার কী বিজনেস?—আমি বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলুম।
—হুঁ হুঁ, আন্দাজ কর দেখি? –চোখ কুঁচকে মিটমিটি হাসতে লাগল টেনিদা; বলতে পারলি না তো? ও—সব কি তোর মতো নিরেট মগজের কাজ? এমনি একটা মাথা চাই, বুঝলি?
সগৌরবে টেনিদা নিজের ব্ৰহ্মতালুতে দুটো টোকা দিলে।
—কেন অযথা ছলনা করছ? বলেই ফেলো না— আমি কাতর হয়ে জানতে চাইলুম।
টেনিদা একবার চারদিকে তাকিয়ে ভালো বরে দেখে নিলে, তারপর আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললে, ফিলিম কোম্পানি!
অ্যাঁ! —আমি লাফিয়ে উঠলাম।
—গাধার মতো চ্যাঁচাসনি— টেনিদা ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠল; সব প্ল্যান ঠিক করে ফেলেছি। তুই গল্প লিখবি— আমি ডাইরেকট —মানে পরিচালনা করব। দেখবি, চারিদিকে হইহই পড়ে যাবে।
—ফিলিমের কী জানো তুমি? আমি জানতে চাইলুম।
—কেইবা জানে? —টেনিদা তাচ্ছিল্যভরা একটা মুখ ভঙ্গি করলে; সবাই সমান— সকলের মগজেই গোবর। তিনটে মারামারি, আটটা গান আর গোটা কতক ঘরবাড়ি দেখালেই ফিলিম হয়ে যায়। টালিগঞ্জে গিয়ে আমি শুটিং দেখে এসেছি তো।
—কিন্তু তবুও—
—ধ্যাৎ, তুই একটা গাড়ল। —টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে, সত্যি-সত্যিই কি আর ছবি তুলব আমরা! ও-সব ঝামেলার মধ্যে কে যাবে!
—তা হলে?
—শেয়ার বিক্রি করব। বেশ কিছু শেয়ার বিক্রি করতে পারলে— বুঝলি তো? —টেনিদা চোখ টিপল; দ্বারিক, ভীমনাগ, দেলখোস, কে. সি. দাস—
এইবার আমার নোলায় জল এসে গেল। চুক চুক করে বললুম— থাক, থাক আর বলতে হবে না।
পরদিন গোটা পাড়াটাই পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেল।
“দি ভজহরি ফিলিম কর্পোরেশন”
আসিতেছে-আসিতেছে
রোমাঞ্চকর বাণীচিত্র
“বিভীষিকা”!
পরিচালনা : ভজহরি মুখোপাধ্যায়। (টেনিদা)
কাহিনী : প্যালারাম বন্দ্যোপাধ্যায়
তার নীচে ছোট ছোট হরফে লেখা:
সর্বসাধারণকে কোম্পানির শেয়ার কিনিবার জন্য অনুরোধ জানানো হইতেছে। প্রতিটি শেয়ারের মূল্য মাত্র আট আনা। একত্রে তিনটি শেয়ার কিনিলে মাত্র এক টাকা।
এর পরে একটা হাত এঁকে লিখে দেওয়া হয়েছে; বিশেষ দ্রষ্টব্য— শেয়ার কিনিলে প্রত্যেককেই বইতে অভিনয়ের চান্স দেওয়া হইবে। এমন সুযোগ হেলায় হারাইবেন না। মাত্ৰ অল্প শেয়ার আছে, এখন না কিনিলে পরে পস্তাইতে হইবে। সন্ধান করুন— ১৮ নং পটলডাঙা স্ট্রিট, কলিকাতা।
আর, বিজ্ঞাপনের ফল যে কত প্ৰত্যক্ষ হতে পারে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাতেনাতে তার প্রমাণ মিলে গেল। এমন প্ৰমাণ মিলল যে প্ৰাণ নিয়ে টানাটানি। অত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা আমরা আশা করিনি। টেনিদাদের এত বড় বাড়িটা। একেবারে খালি, বাড়িসুদ্ধ সবাই গেছে দেওঘরে, হাওয়া বদলাতে। টেনিদার ম্যাট্রিক পরীক্ষা সামনে, তাই একা রয়ে গেছে বাড়িতে, আর আছে চাকর বিষ্ট। তাই দিব্যি আরাম করে বসে আমরা তেতলার ঘরে রেডিয়ো শুনছি আর পাঁঠার ঘুগনি খাচ্ছি। এমন সময় বিষ্ট খবর নিয়ে এল মূর্তিমান একটি ভগ্নদূতের মতো।
বিষ্টুর বাড়ি চাটগাঁয়। হাঁইমাই করে নাকি সুরে কী যে বলে ভালো বোঝা যায় না। তবু যেটুকু বোঝা গেল, শুনে আমরা আঁত়্কে উঠলুম। গলায় পাঁঠার ঘুগনি বেঁধে গিয়ে মস্ত একটা বিষম খেল টেনিদা।
বিষ্টু জানাল : আঁড়িত ডাঁহাইত হইড়ছে (বাড়িতে ডাকাত পড়েছে)।
বলে কী ব্যাটা! পাগল না পেট খারাপ! ম্যাড়া না মিরগেল! এই ভর দুপুর বেলায় একেবারে কলকাতার বুকের ভেতরে ডাকাত পড়বে কী রকম।
বিষ্টু বিবৰ্ণ মুখে জানাল : নীচে হাঁসি দেইক্যা যান (নীচে এসে দেখে যান)। —
আমি ভেবেছিলাম খাটের তলাটা নিরাপদ কিনা, কিন্তু টেনিদা এমন এক বাঘা হাঁকার ছাড়লে যে আমার পালাজ্বরের পিলেটা দস্তুর মতো হকচকিয়ে উঠল।
—কাপুরুষ! চলে আয় দেখি— একটা বোম্বাই ঘুষি হাঁকিয়ে ডাকাতের নাক ন্যাবড়া করে দি!— আমি নিতান্ত গোবেচারা প্যালারাম বাড়ুজ্যে, শিংমাছের ঝোল খেয়ে প্ৰাণটাকে কোনওমতে ধরে রেখেছি, ওসব ডাকাত-ফাকাতের ঝামেলা আমার ভালো লাগে না। বেশ তো ছিলাম, এসব ভজঘট ব্যাপার কেন রে বাবা। আমি বলতে চেষ্টা করলুম, এই—এই মানে, আমার কেমন পেট কামড়াচ্ছে—
—পেট কামড়াচ্ছে! টেনিদা গর্জন করে উঠল : পাঁঠার ঘুগনি সাবাড় করার সময় তো সে কথা মনে ছিল না দেখছি। চলে আয় প্যালা, নইলে তোকেই আগে—
কথাটা টেনিদা শেষ করল না, কিন্তু তার বক্তব্য বুঝতে বেশি দেরি হল না আমার। “জয় মা দুর্গা”—কাঁপতে-কাঁপতে আমি টেনিদাকে অনুসরণ করলুম।
কিন্তু না— ডাকাত পড়েনি। পটলডাঙার মুখ থেকে কলেজ স্ট্রিটের মোড় পর্যন্ত “কিউ!”
কে নেই সেই কিউতে? স্কুলের ছেলে, মোড়ের বিড়িওয়ালা, পাড়ার ঠিকে ঝি, উড়ে ঠাকুর, এমন কি যমদূতের মত দেখতে এক জোড়া ভীম-দৰ্শন কাবুলিওয়ালা।
আমরা সামনে এসে দাঁড়াতেই গগনভেদী কোলাহল উঠল।
—আমি শেয়ার কিনব—
—এই নিন মশাই আট আনা পয়সা—
ঝি বলল, ওগো বাছারা, আমি এক ট্যাকা এনেছি। আমাদের তিনখানা শেয়ার দাও— আর একটা হিরোইনের চান্স দিয়ো—
পাশের বোর্ডিংটার উড়ে ঠাকুর বললে, আমিও আষ্টো গণ্ডা পয়সা আনুচি—
সকলের গলা ছাপিয়ে কাবুলিওয়ালা রুদ্র কণ্ঠে হুঙ্কার ছাড়ল : এঃ বাব্বু, এক এক রূপায়া লায়া, হামকো ভি চান্স চাহিয়ে—
তারপরেই সমস্বরে চিৎকার উঠল; চান্স-চান্স। চিৎকারের চোখে আমার মাথা ঘুরে গেল— দুহাতে কান চেপে আমি বসে পড়লুম।
আশ্চৰ্য, টেনিদা দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে রইল একেবারে শান্ত, স্তব্ধ বুদ্ধদেবের মতো। শুধু তাই নয়, এ-কান থেকে ও-কান পর্যন্ত একটা দাঁতের ঝলক বয়ে গেল তার— মানে হাসল।
তারপর বললে, হবে, হবে, সকলেরই হবে,—বরাভয়ের মতো একখানা হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললে, প্রত্যেককেই চান্স দেওয়া হবে। এখন চাঁদেরা আগে সুড়সুড়ি করে পয়সা বের করো দেখি। খবরদার, অচল আধুলি চালিয়ো না,—তাহলে কিন্তু—
—জয় হিন্দ--জয় হিন্দ—
ভিড়টা কেটে গেলে টেনিদা দু হাত তুলে নাচতে শুরু করে দিলে। তারপর ধপ করে একটা চেয়ারে বসতে গিয়ে চেয়ারসুদ্ধই চিৎপাত হয়ে পড়ে গেল।
আমি বললুম, আহা-হা— কিন্তু টেনিদা উঠে পড়েছে ততক্ষণে। আমার কাঁধের ওপর এমন একটা অতিকায় থাবড়া বসিয়ে দিলে যে, আমি আর্তনাদ করে উঠলুম।
—ওরে প্যালা, আজ দুঃখের দিন নয় রে, বড় আনন্দের দিন। মার দিয়া কেল্লা! ভীমনাগ, দ্বারিক ঘোষ, চাচার হােটেল, দেলখোস-আঃ!
যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে আমিও বললুম, আঃ!
—মায় গুনে দেখি—এ কান থেকে ও কান পর্যন্ত আবার হাসির কলকা উলসে রোজগার নেহাত মন্দ হয়নি। গুনে দেখি, ছব্বিশ টাকা বারো আনা।
—বারো আনা? —টেনিদা ভ্রূকুটি করলে, বারো আনা কী করে হয়? আট আনা এক টাকা করে হলে— উহুঁ! নিশ্চয় ডামাডোলের মধ্যে কোনও ব্যাটা চার গণ্ডা পয়সা ফাঁকি দিয়েছে— কী বলিস?
আমি মাথা নেড়ে জানালুম, আমারও তাই মনে হয়। —উঃ—দুনিয়ায় সবই জোচ্চোর। একটাও কি ভালো লোক থাকতে নেইরে? দিলো সক্কালবেলাটায় বামুনের চার চার আনা পয়সা ঠকিয়ে। —টেনিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : যাক, এতেও নেহাত মন্দ হবে না। দেলখোস, ভীমনাগ, দ্বারিক ঘোষ—
আমি তার সঙ্গে জুড়ে দিলুম, চাচার হােটেল, কে সি দাস—
টেনিদা বললে, ইত্যাদি— ইত্যাদি। কিন্তু শোন প্যালা, একটা কথা আগেই বলে রাখি। প্ল্যানটা আগাগোড়াই আমার। অতএব বাবা সোজা হিসেব— চৌদ্দ আনা—দু আনা।
আমি আপত্তি করে বললুম, অ্যাঁ, তা কী করে হয়?
টেনিদা সজোরে টেবিলে একটা কিল মেরে গর্জন করে উঠল, হুঁ, তাই হয়! আর তা যদি না হয়, তাহলে তোকে সোজা দোতালার জানালা গলিয়ে নীচে ফেলে দেওয়া হয়, সেটাই কি তবে ভালো হয়?
আমি কান চুলকে জানালুম, না সেটা ভালো হয় না!
—তবে চল— গোটা কয়েক মোগলাই পরোটা আর কয়েক ডিশ ফাউল কারি খেয়ে ভজহরি ফিলম কপোরেশনের মহরত করে আসি—
টেনিদা ঘর-ফাটানো একটা পৈশাচিক অট্টহাসি করে উঠল। হাসির শব্দে ভেতর থেকে ছুটে এল বিষ্টু। খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললে, ছটো বাবুর মাথা হাঁড়াপ। (খারাপ) অইচে!——
কিন্তু—দিন কয়েক বেশ কেটে গেল। দ্বারিকের রাজভোগ আর চাচার কাটলেট খেয়ে শরীরটাকে দস্তুরমতো ভালো করে ফেলেছি দুজনে। কে. সি. দাসের রসমালাই খেতে খেতে দুজনে ভাবছি— আবার নতুন কোনও একটা প্ল্যান করা যায় কি না, এমন সময়—
দোরগোড়ায় যেন বাজ ডেকে উঠল। সেই যমদূতের মতো একজোড়া কাবুলিওয়ালা। অতিকায় জাব্বা-জোব্বা আর কালো চাপদাড়ির ভেতর দিয়ে যেন জিঘাংসা ফুটে বেরোচ্ছে।
আমরা ফিরে তাকাতেই লাঠি ঠুকল : এঃ বাব্বু— রূপেয়া কাঁহা—হামলোগ গা চান্স কিধর?
—অ্যাঁঃ! —টেনিদার হাত থেকে রসমালাইটা বুক-পকেটের ভেতর পড়ে গেল : প্যালা রে, সেরেছে!
—সারবেই তো! —আমি বললুম, তবে আমার সুবিধে আছে। চৌদ্দ আনা দু আনা। চৌদ্দ আনা ঠ্যাঙনি তোমার, মানে স্রেফ ছাতু করে দেবে। দু, আনা খেয়ে আমি বাঁচলেও বেঁচে যেতে পারি।
কাবুলিওয়ালা আবার হাঁকল :—এঃ ভজহরি বাব্বু— বাহার তো আও— বাহার আও—মানেই নিমতলা যাও! টেনিদা এক লাফে উঠে দাঁড়াল, তারপর সোজা আমাকে বগলদাবা করে পাশের দরজা দিয়ে অন্যদিকে।
—ওগো ভালো মানুষের বাছারা, আমার ট্যাকা। কই, চান্স কই? ঝি হাতে আঁশবটি নিয়ে দাঁড়িয়ে।
—আমারো চান্সো মিলিবো কি না?—উড়ে ঠাকুর ভাত রাঁধবার খুন্তিটাকে হিংস্রভাবে আন্দোলিত করল।
—জোচ্চুরি পেয়েছেন স্যার—আমরা শ্যামবাজারের ছেলে— আস্তিন গুটিয়ে একদল ছেলে তাড়া করে এল।
এক মুহুর্তে আমাদের চোখের সামনে পৃথিবীটা যেন ঘুরতে লাগল। তারপরেই —‘করেঙ্গে ইয়া মারেঙ্গে!’ আমাকে কাঁধে তুলে টেনিদা একটা লাফ মারল। তারপর আমার আর ভালো করে জ্ঞান রইল না। শুধু টের পেলুম, চারিদিকে একটা পৈশাচিক কোলাহল; চোট্টা—চোট্টা—ভাগ যাতা—আর বুঝতে পারলুম— যেন পাঞ্জাব মেলে চড়ে উড়ে চলেছি।
ধপাৎ করে মাটিতে পড়তেই আমি হিউমাউ করে উঠলুম। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি, হাওড়া স্টেশন। রেলের একটা ইঞ্জিনের মতোই হাঁপাচ্ছে টেনিদা।
বললে, হুঁ হুঁ বাবা, পাঁচশো মিটার দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন— আমাকে ধরবে ওই ব্যাটারা! যা প্যালা- পকেটে এখনও বারো টাকা চার আনা রয়েছে, ঝট করে দুখানা দেওঘরের টিকিট কিনে আন। দিল্লি এক্সপ্রেস এখুনি ছেড়ে দেবে।
প্রভাতসঙ্গীত - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
টেনিদা। অসম্ভব গম্ভীর । আমরা তিনজনও যতটা পারি গভীর হওয়ার চেষ্টা করছি। ক্যাবলার মুখে একটা চুয়িং গাম ছিল, সেটা সে ঠেলে দিয়েছে গালের একপাশে—যেন একটা মার্বেল গালে পুরে রেখেছে। এই রকম মনে হচ্ছে। পটলডাঙার মোড়ে তেলেভাজার দোকান থেকে আলুর চপ আর বেগুনী ভাজার গন্ধ আসছে, তাইতে মধ্যে-মধ্যে উদাস হয়ে যাচ্ছে হাবুল সেন। কিন্তু আজকের আবহাওয়া অত্যন্ত সিরিয়াস-তেলেভাজার এমন প্রাণকাড়া গন্ধেও টেনিদা কিছুমাত্র বিচলিত হচ্ছে না ।
খানিক পরে টেনিদা বলল, পাড়ার লোকগুলো কী—বলদিকি ?
আমি বললুম, অত্যন্ত বোগাস।
খাঁড়ার মতো নাকটাকে আরও খানিক খাড়া করে টেনিদা বললে, পয়সা তো অনেকেরই আছে। মোটরওলা বাবুও তো আছেন ক’জন । তবু আমাদের একসারসাইজ ক্লাবকে চাঁদা দেবে না ?
না—দিব না।—হাবুল সেন মাথা নেড়ে বললে, কয়—একসারসাইজ কইর্যা কী হইব ? গুণ্ডা হইব কেবল !
হ, গুণ্ডা হইব !—টেনিদা হাবুলকে ভেংচে বললে, শরীর ভালো করবার নাম হল গুণ্ডাবাজি ! অথচ বিসর্জনের লরিতে যারা ভুতুড়ে নাচ নাচে, বাঁদরামো করে, তাদের চাঁদা দেবার বেলায় তো পয়সা সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসে। প্যালার মতো রোগা টিকটিকি না হয়ে—
বাধা দিয়ে বললুম, আবার আমাকে কেন ?
ইউ শাটাপ । —টেনিদা বাঘাটে হুংকার ছাড়ল : ‘আমার কথার ভেতরে কুরুবকের মতো—খুব বিচ্ছিরি একটা বকের মতো বকবক করবি না—সে-কথা বলে দিচ্ছি তোকে । প্যালার মতো রোগা টিকটিকি না হয়ে পাড়ার ছেলেগুলো দুটাে ডাম্বেল-মুগুর ভাঁজুক, ডন দিক—এই তো আমরা চেয়েছিলুম। শরীর ভালো হবে, মনে জোর আসবে, অন্যায়ের সামনে রুখে দাঁড়াবে, বড় কাজ করতে পারবে। তার নাম গুণ্ডাবাজি ! অথচ দ্যাখ—দু-চারজন ছাড়া কেউ একটা পয়সা ঠেকাল না। আমরা নিজেরা চাঁদা-টাদা দিয়ে দু-একটা ডাম্বেল-টাম্বেল কিনেছি, কিন্তু চেস্ট একসপ্যান্ডার, বারবেল—ৎ
ক্যাবলা আবার চুয়িং গামটা চিবােতে আরম্ভ করল। ভরাট মুখে বললে, কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না।
হাবুল মাথা নাড়ল : দিব না। ক্লাব তুইলা দাও টেনিদা।
‘তুলে দেব ? কভি নেহি—’ টেনিদার সারা মুখে মোগলাই পরোটার মতো একটা কঠিন প্রতিজ্ঞা ফুটে বেরুল : চাঁদা তুলবই । ইউ প্যালা ৷
আঁতকে উঠে বললুম, অ্যাঁ?
আমাদের নিয়ে তো খুব উষ্টুম-ধুষ্টুম গপ্পো বানাতে পারিস, কাগজে ছাপাটাপাও হয়। একটা বুদ্ধি টুদ্ধি বের করতে পারিস নে ?
মাথা চুলকে বললুম, আমি—আমি—
‘হাঁ-হাঁ, তুই-তুই।’—টেনিদা কটাং করে আমার চাঁদিতে এমন গাঁটা মারল যে ঘিলুটিলু সব নড়ে উঠল এক সঙ্গে। আমি কেবল বললুম, ক্যাঁক ৷
ক্যাবলা বললে, ও-রকম গােটা মারলে তো বুদ্ধি বেরুবে না, বরং তালগোল পাকিয়ে যাবে সমস্ত । এখন ক্যাঁক বলছে, এর পরে ঘ্যাঁক-ঘ্যাঁক বলতে থাকবে আর ফস করে কামড়ে দেবে কাউকে ।
গাঁট্টার ব্যথা ভুলে আমি চটে গেলুম।
ঘ্যাঁক করে কামড়াব কেন ? আমি কি কুকুর ?
টেনিদা বললে, ইউ শাটাপ-অকর্মার ধাড়ি ।
হাবুল বললে, চুপ কইর্যা থাক প্যালা—আর একখান গাঁট্টা খাইলে ম্যাও-ম্যাও কইর্যা বিলাইয়ের মতন ডাকতে আরম্ভ করবি । অরে ছাইড়া দাও টেনিদা । আমার মাথায় একখান বুদ্ধি আসছে।
টেনিদা ভীষণ উৎসাহ পেয়ে ঢাকাই ভাষা নকল করে ফেলল : কইয়্যা ফ্যালাও ৷
গানের পার্টি ? মানে—সেই যে চাঁদা দাও গো পুরবাসী ? আর শালু নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াব?’—টেনিদা দাঁত খিচিয়ে বললে, ‘আহা-হা, কী একখানা বুদ্ধিই বের করলেন । লোকে সেয়ানা হয়ে গেছে, ওতে, আর চিড়ে ভেজে ? সারা দিন ঘুরে হয়তো পাওয়া যাবে বত্ৰিশটা নয়া পয়সা আর দু:খানা ছেড়া কাপড়। দুদ্দুর!
ক্যাবলা টকাৎ করে চুয়িং গামটাকে আবার গালের একপাশে ঠেলে দিলে।
টেনিদা—দি আইডিয়া ।
আমরা সবাই একসঙ্গে ক্যাবলার দিকে তাকালুম। আমাদের দলে সেই-ই সব চেয়ে ছোট আর লেখাপড়ায় সবার সেরা— হায়ার সেকেন্ডারিতে ন্যাশনাল স্কলার । খবরের কাগজে কুশলকুমার মিত্রের ছবি বেরিয়েছিল স্ট্যান্ড করবার পরে, তোমরা তো সে-ছবি দেখেছি। সেই ই ক্যাবলা ।
ক্যাবলা ছোট হলেও আমাদের চার মূর্তির দলে সেই-ই সবচেয়ে জ্ঞানী, চশমা নেবার পরে তাকে আরও ভারিক্কি দেখায়। তাই ক্যাবলা কিছু বললে আমরা সবাই-ই মন দিয়ে তার কথা শুনি ।
ক্যাবলা বললে, আমরা শেষ রাত্ৰে-মানে এই ভোরের আগে বেরুতে পারি সবাই।
‘শেষ রাত্তিরে!’—হাবুল হাঁ করে রইল : শেষ রাত্তিরে ক্যান ? চুরি করুম নাকি আমরা ?
‘চুপ কর না হাবলা—’ ক্যাবলা বিরক্ত হয়ে বললে, ‘আগে ফিনিশ করতে দে আমাকে । আমি দেখেছি, ভোরবেলায় ছোট-ছোট দল কীর্তন গাইতে বেরোয় । লোকে রাগ করে না, সকালবেলায় ভগবানের নাম শুনে খুশি হয়। পয়সাটয়সাও দেয় নিশ্চয় ।
টেনিদা বললে, হুঁ, রাত্তিরে ঘুমিয়ে টুমিয়ে ভোরবেলায় লোকের মন খুশিই থাকে। তারপর যেই বাজারে কুমড়ো-কাঁচকলা আর চিংড়ি মাছ কিনতে গেল, অমনি মেজাজ খারাপ । আর অফিস থেকে ফেরবার পরে তো-ইরে বাবাস ।
আমি বললুম, মেজদা যেই হাসপাতাল থেকে আসে—অমনি সক্কলকে ধরে ইনজেকশন দিতে চায় ৷
হাবুল বললে, তর মেজদা যদি পাড়ার বড় লোকগুলারে ধইরা তাগো পুটুস-পুটুস কইর্যা ইনজেকশন দিতে পারত—
টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল ; ‘অর্ডার-অর্ডার, ভীষণ গোলমাল হচ্ছে। কিন্তু ক্যাবলার আইডিয়াটা আমার বেশ মনে ধরেছে—মানে যাকে বলে সাইকোলজিক্যাল। সকালে লোকের মন খুশি থাকে—ইয়ে যাকে বলে বেশ পবিত্র থাকে, তখন এক-আধটা বেশ ভক্তিভরা গান-টান শুনলে কিছু না-কিছু দেবেই। রাইট । লেগে পড়া যাক তা হলে ৷
আমি বললুম, কিন্তু জিমন্যাস্টিক ক্লাবের জন্যে আমরা হরিসংকীর্তন গাইব ?
ক্যাবলা বললে, হরি-সংকীর্তন কেন ? তুই তো একটু-আধটু লিখতে পারিস, একটা গান লিখে ফ্যাল। ভীম, হনুমান—এইসব বীরদের নিয়ে বেশ জোরালো গান।
আমি—
‘হাঁ, তুই, তুই।’ —টেনিদা আবার গাঁট্টা তুলল : মাথার ঘিলুটা আর একবার নড়িয়ে দিই, তা হলেই একেবারে আকাশবাণীর মতো গান বেরুতে থাকবে ।
আমি এক লাফে নেমে পড়লুম। চাটুজ্যেদের রোয়াক থেকে ।
বেশ, লিখব গান। কিন্তু সুর দেবে কে ?
টেনিদা বললে, আরে সুরের ভাবনা কী—একটা কেত্তন-ফেক্তন লাগিয়ে দিলেই হল।
‘আর গাইব কেডা?’ হাবুলের প্রশ্ন শোনা গেল : আমাগো গলায় তো ভাউয়া ব্যাংয়ের মতন আওয়াজ বাইর অইব ।
‘হ্যাং ইয়োর ভাউয়া ব্যাং।’ —টেনিদা বললে, ‘এ-সব গান আবার জানতে হয় নাকি ?’ গাইলেই হল । কেবল আমাদের থান্ডার ক্লাবের গোলকিপার পাঁচুগোপালকে একটু যোগাড় করতে হবে, ও হারমোনিয়াম বাজাতে পারে—গাইতেও পারে-মানে আমাদের লিড করবে।
হাবুল বললে,“আমাগো বাড়িতে একটা কর্তাল আছে, লইয়া আসুম।
ক্যাবলা বললে, আমাদের ঠাকুর দেশে গেছে, তার একটা ঢোল আছে। সেটা আনতে পারি ।
‘গ্র্যান্ড !’—টেনিদা ভীষণ খুশি হল : ‘ওটা আমিই বাজাব এখন। দেন এভরিথিং ইজ কমপ্লিট । শুধু গান বাকি। প্যালা-হাফ অ্যান আওয়ার টাইম । দৌড়ে চলে যা—গান লিখে নিয়ে আয় । এর মধ্যে আমরা একটু তেলেভাজা খেয়েনি ৷
মাথা চুলকে আমি বললুম, আমিও দুটাে তেলেভাজা খেয়ে গান লিখতে যাই না কেন? মানে—দু-একটা আলুর চপ-টপ খেলে বেশ ভাব আসত।
আর আলুর চাপ খেয়ে কাজ নেই। যা-বাড়ি যা—কুইক । আধা ঘণ্টার মধ্যে গান লিখে না আনলে ভাব কী করে বেরোয় আমি দেখব। কুইক—কুইক—
টেনিদা রোয়াক থেকে নেমে পড়তে যাচ্ছিল। অগত্যা আমি ছুট লাগালুম। কুইক নয়—কুইকেস্ট যাকে বলে।
জাগো রে নগরবাসী, ভজো হনুমান
করিবেন তোমাদের তিনি বলবান ।
ও গাে—সকালে বিকালে যেবা করে ভীমনাম
সেই হয় মহাবীর—নানা গুণধাম ।
জাগো রে নগরবাসী—ডন দাও, ভাঁজো রে ডামবেল,
খাও রে পরান ভরি ছোলা-কলা-আম-জাম-বেলহ
ও রে সকলে বীর, হও ভীম, হাও হনুমান,
জাগিবে ভারত এতে করি অনুমান।
ক্যাবলা গান শুনে বললে, আবার অনুমান করতে গেলি কেন? লেখ-জাগিবে ভারত এতে পাইবে প্ৰমাণ ।
টেনিদা বললে, রাইট । কারেকটি সাজেসশন ৷
হাবুল বললে, কিন্তু মানুষরে হনুমান হইতে কইবা? চেইত্যা যাইব না ?
টেনিদা বললে, চটবে কেন? পশ্চিমে হনুমানজীর কত কদর। জয় হনুমান বলেই তো কুস্তি করতে নামে। হনুমান সিং—হনুমানপ্ৰসাদ, এ-রকম কত নাম হয় ওদের। হনুমান কি চাড্ডিখানা কথা রে । এক লাফে সাগর পেরুলেন, লঙ্কা পোড়ালেন, গন্ধমাদন টেনে আনলেন, রাবণের রথের চুড়োটা কড়মড়িয়ে চিবিয়ে দিলেন—এক দাঁতের জোরটাই ভেবে দ্যাখ একবার।
‘তবে কিনা—খাও রে পরান ভরি ছোলা-কলা-আম-জাম-বেল—’চুয়িং গাম খেতে খেতে ক্যাবলা বললে, এই লাইনটা ঠিক—
আমি বললুম, বারে, গানে রস থাকবে না? কলা-আম-জামে কত রস বল দিকি? আর দুটাে-চারটে ভালো জিনিস খাওয়ার আশা না থাকলে লোকে খামকা ডামবেল-বারবেল ভাঁজতেই বা যাবে কেন ? লোভও তো দেখাতে হয় একটু ৷
‘ইয়া!’—টেনিদা ভীষণ খুশি হল : ‘এতক্ষণে প্যালার মাথা খুলেছে। এই গান গেয়েই আমরা কাল ভোররাত্তিরে পাড়ায় কীর্তন গাইতে বেরুব । ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস—
আমরা তিনজন চেচিয়ে উঠলুম। :“ইয়াক—ইয়াক ?
এবং পরদিন ভোরে—
শ্রদ্ধানন্দ পার্কের কাছে কাক ডাকবার আগে, ঝাড়ুদার বেরুনাের আগে প্রথম ট্রাম দেখা না দিতেই—
জাগো রে নগরবাসী, ভজো হনুমান—
আগে-আগে গলায় হারমোনিয়াম নিয়ে পাঁচুগোপাল। তার পেছনে ঢোল নিয়ে টেনিদা, টেনিদার পাশে কর্তাল হাতে ক্যাবলা। থার্ড লাইনে আমি আর হাবুল সেন। টেনিদা বলে দিয়েছে, তোদের দুজনের গলা একেবারে দাঁড়কাকের মতো বিচ্ছিরি, কোনও সুর নেই, তোরা থাক ব্যাক-লাইনে ।
আহা—টেনিদা যেন গানের গন্ধৰ্ব্ব । একদিন কী মনে করে যেন সন্ধ্যাবেলায় গড়ের মাঠে সুর ধরেছিল—‘আজি দখিন দুয়ার খোলা এসো হে, এসো হে, এসো হে।’ কিন্তু আসবে কে ? জন তিনেক লোক অন্ধকারে ঘাসের ওপর শুয়েছিল, দু লাইন শুনেই তারা তড়াক তড়াক করে উঠে বসিল, তারপর তৃতীয় লাইন ধরতেই দুড়দুড় করে টেনে দৌড় এসপ্ল্যানেডের দিকে—যেন ভূতে তাড়া করেছে!
আমি বলতে যাচ্ছিলুম, তোমার গলায় তো মা সরস্বতীর রাজহাঁস ডাকে—
কিন্তু হাবুল আমায় থামিয়ে দিলে বললে, চুপ মাইর্যা থাক। ভালোই হইল, তর আমার গাইতে হইব না। অরা তিনটায় গাঁ-গাঁ কইর্যা চ্যাঁচাইব, তুই আর আমি পিছন থিক্য অ্যাঁ-অ্যাঁ করুম।
সুতরাং রাস্তায় বেরিয়েই পাঁচুর হারমোনিয়ামের প্যাঁ প্যাঁ আওয়াজ, টেনদিার দুমদাম ঢোল আর ক্যাবলার ঝমাঝম কর্তাল। তারপরেই বেরুল সেই বাঘা কীর্তন:
“ওগো—সকালে বিকালে যেবা করে ভীমনাম—”
পাঁচুর পিনপিনে গলা, টেনিদার গগনভেদী চিৎকার, ক্যাবলার ক্যাঁ-ক্যাঁ আওয়াজ, হাবুলের সর্দি-বসা স্বর আর সেই সঙ্গে আমার কোকিল-খাওয়া রব । কোরাস তো দূরে থাক—পাঁচটা গলা পাঁচটা গোলার মতো দিগ্বিদিকে ছুটিল ;
“জাগো রে নগরবাসী, ডন দাও-ভাঁজো রে ডামবেল—”
ঘোঁয়াক ঘোঁয়াক করে আওয়াজ হলো, দুটো কুকুর সারা রাত চেঁচিয়ে কেবল একটু ঘুমিয়েছে—তারা বাঁইবাঁই করে ছুটল। গড়ের মাঠের লোকগুলো তো তবু এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত দৌড়েছিল, এরা ডায়মন্ড হারবারের আগে গিয়ে থামবে বলে মনে হল না ।
এবং তৎক্ষণাৎ—
দড়াম করে খুলে গেল ঘোষেদের বাড়ির দরজা। বেরুলেন সেই মোটা গিন্নী—যাঁর চিৎকারে পাড়ায় কাক-চিল পড়তে পায় না।
আমাদের কোরাস থেমে গেল তাঁর একটি সিংহগর্জনে ।
কী হচ্ছে অ্যাঁ ! এই লক্ষ্মীছাড়া হতভাগা টেনি-কী আরম্ভ করেছিস এই মাঝরাত্তিরে ?
অত বড় লিডার টেনিদাও পিছিয়ে গেল তিন পা !
মানে মাসিমা—মানে ইয়ে এই—ইয়ে—একসারসাইজ ক্লাবের জন্য চাঁদা—
চাঁদা ! অমন মড়া-পোড়ানো গান গেয়ে—পাড়াসুদ্ধ লোকের পিলে কাঁপিয়ে মাঝরাত্তিরে চাঁদা? দূর হ এখেন থেকে ভূতের দল, নইলে পুলিশ ডাকব এক্ষুনি ।
দড়াম করে দরজা বন্ধ হল পরক্ষণেই । কীর্তন-পার্টি শোকসভার মতো স্তব্ধ একেবারে ! হাবুল করুণ স্বরে বলল,“হইব না টেনিদা। এই গানে কারও হৃদয় গলব না মনে হইত্যাছে ৷
হবে না মানে ?—টেনিদা পান্তুয়ার মতো মুখ করে বললে, হতেই হবে। লোকের মন নরম করে তবে ছাড়ব ।
কিন্তু ঘোষমসিমা তো আরও শক্ত হয়ে গেলেন —আমাকে জানাতে হল ।
উনি তো কেবল চেঁচিয়ে ঝগড়া করতে পারেন, জিমন্যাস্টিকের কী বুঝবেন। অলরাইট—নেকসট হাউস। গজকেষ্টবাবুর বাড়ি ।
আবার পদযাত্ৰা । আর সম্মিলিত রাগিণী ;
“খাও রে পরান ভরি ছোলা-কলা-আম-জাম-বেল—
হও রে সকলে বীর, হাও ভীম, হাও হনুমান—”
পাঁচু, টেনিদা, ক্যাবলা তেড়ে কেবল ‘হও হনুমান’ পর্যন্ত গেয়েছে, আমি আর হাবলা ‘আম’ পর্যন্ত বলে সুর মিলিয়েছি, অমনি গজকেষ্ট হালদারের দোতালার ঝুলবারান্দা থেকে—
না, চাঁদ নয় ! প্রথমে একটা ফুলের টব, তার পরেই একটা কুঁজো । মেঘনাদকে দেখা গেল না, কিন্তু টবটা আর একটু হলেই আমার মাথায় পড়ত, আর কুঁজোটা একেবারে টেনিদার মৈনাকের মতো নাকের পাশ দিয়ে ধাঁ করে বেরিয়ে গেল ।
আমি চেঁচিয়ে বললুম, টেনিদা—গাইডেড মিশাইল।
বলতে-বলতেই আকাশ থেকে নেমে এল প্ৰকাণ্ড এক হুলো বেড়াল-পড়ল পাঁচুর হারমোনিয়ামের ওপর। খ্যাঁচ-ম্যাচ করে এক বিকট আওয়াজ— হারমোনিয়ামসুদ্ধ পাঁচু একেবারে চিৎ—আর ক্যাঁচ-ক্যাঁচাঙ বলে বেড়ালটা পাশের গলিতে উধাও !
ততক্ষণে আমরা উর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছি। প্রায় হ্যারিসন রোড পর্যন্ত দৌড়ে থামতে হল আমাদের। পাঁচু কাঁদো-কাঁদো গলায় বললে, টেনিদা, এনাফ। এবার আমি বাড়ি যাব ৷
হাবুল বললে, হ, নাইলে মারা পোড়বা সক্কলে । অখন কুজা ফ্যালাইছে, এইবারে সিন্দুক ফ্যালাইব । অখন বিলাই ছুইর্যা মারছে, এরপর ছাত থিক্য গোরু ফ্যালাইব ।
টেনিদা বললে, শাট আপ—ছাতে কখনও গোরু থাকে না ।
না থাকুক গোরু—ফিক্যা মারতে দোষ কী । আমি অখন যাই গিয়া । হিস্ট্রি পড়তে হইব ।
এঃ—হিস্ট্রি পড়বেন !—টেনিদা বিকট ভেংচি কাটল : ‘ইদিকে তো আটটার আগে কোনওদিন ঘুম ভাঙে না। খবদার হাবলা—পালানো চলবে না। আর একটা চানস নেব । এত ভালো গান লিখেছে প্যালা, এত দরদ দিয়ে গাইছি আমরা—জয় হনুমান আর বীর ভীমসেন মুখ তুলে চাইবেন না ? এবং মহৎ কাজ করতে যাচ্ছি। আমরা—কিছু চাঁদা জুটিয়ে দেবেন না তাঁরা? ট্রাই—ট্রাই এগেন । মন্ত্রের সাধন কিংবা—ধর, পাঁচু—
পাঁচুগোপাল কাঁউমাউ করতে লাগল। : ‘একসকিউজ মি টেনিদা। পেল্লায় হুলো বেড়াল, আর একটু হলেই নাক-ফাক অাঁচড়ে নিত আমার । আমি বাড়ি যাব।
বাড়ি যাবেন?—টেনিদা আবার একটা যাচ্ছেতাই ভেংচি কাটল : ‘মামাবাড়ির আবদার পেয়েছিস, না ? টেক কেয়ার পেঁচো- ঠিক এক মিনিট সময় দিচ্ছি। যদি গান না ধরিস, এক থাপ্পড়ে তোর কান—
ক্যাবলা বললে, কানপুরে চলে যাবে।
আমি হাবুলের কানে-কানে বললুম, লোকে আমাদের এর পরে ঠেঙিয়ে মারবে, হাবলা । কী করা যায় বল তো ?
তুই গান লেইখ্যা ওস্তাদি করতে গেলি ক্যান ?
সংকীর্তন গাইবার বুদ্ধি তো তুই-ই দিয়েছিলি ৷
হাবুল কী বলতে যাচ্ছিল, আবার প্যাঁ-প্যাঁ করে হারমোনিয়াম বেজে উঠল পাঁচুর । এবং :
“জাগো রে নগরবাসী-ভজো হনুমান—”
ঢোলক-করতালের আওয়াজে আবার চারদিকে ভূমিকম্প শুরু হল। আর পাঁচটি গলার স্বরে সেই অনবদ্য সংগীতচর্চা ;
“করিবেন তোমাদের তিনি বলবান—
কোনও সাড়াশব্দ নেই কোথাও। কুঁজো নয়, বেড়াল নয়, গাল নয়, কিছু নয়। সামনে কন্ট্রাকটার বিধুবাবুর নতুন তেতলা বাড়ি নিথর ।
আমাদের গান চলতে লাগল। :
“ওগো—সকালে বিকালে যেবা করে ভীমনাম—”
‘ডামবেল’ পর্যন্ত যেই এসেছে, দড়াম করে দরজা খুলে গেল আবার । গায়ে একটা কোট চড়িয়ে, একটা সুটকেস হাতে প্রায় নাচতে-নাচতে বেরুলেন বাড়ির মালিক বিধুবাবু।
আমি আর হাবলা টেনে দৌড় লাগাবার তালে আছি, আঁক করে পাঁচুর গান থেমে গেছে, টেনিদার হাত থমকে গেছে ঢোলের ওপর। বিধুবাবু আমাদের মাথায় সুটকেস ছুড়ে মারবেন। কিনা বোঝবার আগেই—
ভদ্রলোক টেনিদাকে এসে জাপটে ধরলেন সুটকেসসুদ্ধ। নাচতে লাগলেন তারপর ।
বাঁচালে টেনিরাম, আমায় বাঁচালে । অ্যালার্ম ঘড়িটা খারাপ হয়ে গেছে, তোমাদের ডাকাত-পড়া গান কানে না এলে ঘুম ভাঙত না ; পাঁচটা সাতের গাড়ি ধরতে পারতুম না-দেড় লাখ টাকার কন্ট্রাকটিই হাতছাড়া হয়ে যেত। কী চাই তোমাদের বলো । শেষ রাতে তিনশো শেয়ালের কান্না কেন জুড়ে দিয়েছ। বলো—আমি তোমাদের খুশি করে দেব।
‘শেয়ালের কান্না না স্যার—শেয়ালের কান্না না !’—বিধুবাবুর সঙ্গে নাচতে-নাচতে তালে-তালে টেনিদা বলে যেতে লাগল। : ‘একসারসাইজ ক্লাব-ডামবেল-বারবেল কিনব-অন্তত পঞ্চাশটা টাকা দরকার—’
বেলা ন’টা। রবিবারের ছুটির দিন। চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে আছি আমরা। পাঁচুগোপালও গেস্ট হিসেবে হাজির আছে আজকে ।
মেজাজ আমাদের ভীষণ ভালো । পঞ্চাশ টাকা দিয়ে গেছেন বিধুবাবু। সামনের মাসে আরও পঞ্চাশ টাকা দেবেন কথা দিয়েছেন ।
নিজের পয়সা খরচ করে টেনিদা আমাদের আইসক্রিম খাওয়াচ্ছিল। আইসক্রিম শেষ করে, কাগজের গেলাসটাকে চাটতে-চাটিতে বলল, তবে যে বলেছিলি হনুমান আর ভীমের নামে কাজ হয় না ? হুঁ হুঁ—কলিকাল হলে কী হয়, দেবতার একটা মহিমে আছে না ?
পাঁচু বললে, আর হুলো বেড়ালটা যদি আমার ঘাড়ে পড়ত—
আমি বললুম, আর ফুলের টব যদি আমার মাথায় পড়ত—
হাবুল বললে, কুঁজাখান যদি দিমাস কইর্যা তোমার নাকে লাগত—
টেনিদা বললে, হ্যাং ইয়ের হুলো বেড়াল, ফুলের টব, কুঁজো ! ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস—?
আমরা চেঁচিয়ে বললু, ইয়াক ইয়াক।
বিষয় ভিত্তিক বিভাগ
- অভিযানের গল্প
- আকবর-বীরবল
- আদিবাসী উপকথা
- আদিবাসী লোককথা
- আনন্দ পাঠ
- আলাস্কার উপকথা
- ইংল্যান্ডের রূপকথা
- ইসলাম ধর্মের গল্প
- ঈশপের গল্প
- উপনিষদের গল্প
- কথাসরিৎসাগর
- কল্পবিজ্ঞানের গল্প
- কাজাখ লোককাহিনী
- কিশোর কবিতা
- কিশোর গল্প
- কিশোর বড় গল্প
- কিশোর রহস্য গল্প
- ক্রীলফের নীতিগল্প
- গল্পের ঝাঁপি
- গোপাল ভাঁড়
- গোয়েন্দা গল্প
- গোয়েন্দা নাসের পাশা
- গ্রীমভাইদের রূপকথা
- চাঁদমামা পত্রিকার গল্প
- চীনা উপকথা
- ছড়া
- ছোটদের আরব্য রজনী
- ছোটদের গল্প শোনার আসর
- জাতকের গল্প
- জার্মানের উপকথা
- জার্মানের রূপকথা
- টেনিদা
- ডাকাতের গল্প
- ড্রাকুলা
- তিন গোয়েন্দা
- তিব্বতের লোককাহিনী
- দ্য জঙ্গল বুক
- নরওয়ের রূপকথা
- নানা দেশের উপকথা
- নীতি গল্প
- পঞ্চতন্ত্রের গল্প
- পটলা
- পাখির ছড়া
- পান্ডব গোয়েন্দা
- ফেলুদা
- বত্রিশ পুতুলের উপাখ্যান
- বত্রিশ সিংহাসন
- বাংলাদেশের লোককাহিনী
- বিক্রম-বেতাল
- বিখ্যাতদের মজার ঘটনা
- বিদেশী রূপকথা
- বিদেশী লোককাহিনী
- বিষ্ণুশর্মার গল্প
- বেতাল পঞ্চবিংশতি
- বৌদ্ধ ধর্মের গল্প
- ভারতের লোককাহিনী
- ভুতের গল্প
- ভূতের গল্প
- মজার ছড়া
- মণিপুরী রূপকথা
- মুক্তিযুদ্ধের গল্প
- মোগলি
- রম্যরচনা
- রহস্য ও অভিযান
- রাশিয়ার উপকথা
- রূপকথার গল্প
- রোমাঞ্চকর গল্প
- লাটভিয়ার উপকথা
- শার্লক হোমস
- শিকার কাহিনী
- শেখ সাদীর নীতি গল্প
- সোনামণির ছড়া
- স্বাধীনতার ছড়া
- স্মৃতিচারণমূলক গল্প
- হাসির গল্প
- হিতোপদেশের গল্প
- হিন্দু ধর্মের গল্প

লেখক তালিকা
- অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত
- অজয় রায়
- অজেয় রায়
- অদ্রীশ বর্ধন
- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- অভিযানের গল্প
- অমিতাভ রায়
- আইজ্যাক আসিমভ
- আকবর-বীরবল
- আখতার হুসেন
- আদিবাসী উপকথা
- আদিবাসী লোককথা
- আনন্দ পাঠ
- আবু কায়সার
- আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ
- আমাদের ছেলেবেলার গল্প
- আমীরুল ইসলাম
- আল ফারুক
- আলাস্কার উপকথা
- আশা দেবী
- আশাপূর্ণা দেবী
- আশিস সান্যাল
- আহমেদ ফারুক
- ইন্দুভূষণ রায়
- ইমরুল চৌধুরী
- ইংল্যান্ডের রূপকথা
- ইসলাম ধর্মের গল্প
- ঈশপের গল্প
- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
- উত্থানপদ বিজলী
- উপনিষদের গল্প
- উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
- উল্লাস মল্লিক
- এখলাসউদ্দিন আহমদ
- ওস্কার ওয়াইল্ড
- কথাসরিৎসাগর
- কল্পবিজ্ঞানের গল্প
- কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায়
- কাইয়ুম চৌধুরী
- কাজাখ লোককাহিনী
- কাজী আনোয়ার হোসেন
- কিশোর কবিতা
- কিশোর গল্প
- কিশোর বড় গল্প
- কিশোর রহস্য গল্প
- ক্রীলফের নীতিগল্প
- ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
- খগেন্দ্রনাথ মিত্র
- গল্পের ঝাঁপি
- গোপাল ভাঁড়
- গোয়েন্দা গল্প
- গোয়েন্দা নাসের পাশা
- গ্রীমভাইদের রূপকথা
- চাঁদমামা পত্রিকার গল্প
- চিত্রা দেব
- চীনা উপকথা
- ছড়া
- ছোটদের অডিও গল্প
- ছোটদের আরব্য রজনী
- ছোটদের গল্প শোনার আসর
- জয়া মিত্র
- জসীম উদ্দীন
- জাতকের গল্প
- জার্মানের উপকথা
- জার্মানের রূপকথা
- টেনিদা
- ডাকাতের গল্প
- ড্রাকুলা
- তারাপদ রায়
- তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
- তিন গোয়েন্দা
- তিব্বতের লোককাহিনী
- তোমাদের লেখা
- দুলেন্দ্র ভৌমিক
- দ্য জঙ্গল বুক
- ধীরেন্দ্রলাল ধর
- নজরুল ইসলাম
- ননীগোপাল চক্রবর্তী
- নন্টে-ফন্টে
- নরওয়ের রূপকথা
- নরেন্দ্র দেব
- নানা দেশের উপকথা
- নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
- নিমাই ভট্টাচার্য
- নিয়ামত হোসেন
- নির্মলেন্দু গৌতম
- নীতি গল্প
- পঞ্চতন্ত্রের গল্প
- পটলা
- পরশুরাম
- পরিমল ভট্টাচার্য
- পরেশ দত্ত
- পাখির ছড়া
- পান্ডব গোয়েন্দা
- পূর্ণেন্দু পত্রী
- প্রণব মুখোপাধ্যায়
- প্রফুল্ল রায়
- প্রেমেন্দ্র মিত্র
- ফয়েজ আহমদ
- ফেলুদা
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- বত্রিশ পুতুলের উপাখ্যান
- বত্রিশ সিংহাসন
- বন্দে আলী মিয়া
- বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
- বলরাম বসাক
- বশীর আল হেলাল
- বাংলাদেশের লোককাহিনী
- বিক্রম-বেতাল
- বিখ্যাতদের মজার ঘটনা
- বিদেশী রূপকথা
- বিদেশী লোককাহিনী
- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিমল কর
- বিশু মুখোপাধ্যায়
- বিষ্ণুশর্মার গল্প
- বুলবন ওসমান
- বেতাল পঞ্চবিংশতি
- বেলাল চৌধুরী
- বৌদ্ধ ধর্মের গল্প
- ব্রাম স্টোকার
- ভারতের লোককাহিনী
- ভুতের গল্প
- ভূতের গল্প
- মঈনুল আহসান সাবের
- মজার ছড়া
- মঞ্জিল সেন
- মণিপুরী রূপকথা
- মনোজ বসু
- ময়ুখ চৌধুরী
- মহাশ্বেতা দেবী
- মানবেন্দ্র পাল
- মাহবুব তালুকদার
- মাহমুদ আল জামান
- মাহমুদুল হক
- মিলন গাঙ্গুলী
- মুক্তিযুদ্ধের গল্প
- মুনতাসীর মামুন
- মুর্তজা বশীর
- মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- মুহাম্মদ রিয়াজুল আমীন
- মোগলি
- মোল্লা নাসিরউদ্দিন
- মোহাম্মদ নাসির আলী
- যোগেন্দনাথ গুপ্ত
- যোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
- রকিব হাসান
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রম্যরচনা
- রশীদ হায়দার
- রহস্য ও অভিযান
- রাজশেখর বসু
- রাধারানী দেবী
- রাবেয়া খাতুন
- রাশিয়ার উপকথা
- রাহাত খান
- রুডিয়ার্ড কিপলিং
- রূপকথার গল্প
- রোমাঞ্চকর গল্প
- লাটভিয়ার উপকথা
- লিও টলস্টয়
- লীলা মজুমদার
- লুৎফর চৌধুরী
- লুৎফর রহমান রিটন
- শওকত আলী
- শক্তিপদ রাজগুরু
- শরত্কুমার মুখোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
- শার্লক হোমস
- শাহরিয়ার কবির
- শিকার কাহিনী
- শিবরাম চক্রবর্তী
- শিবশঙ্কর মিত্র
- শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- শেখ সাদীর নীতি গল্প
- শেখর আহমেদ
- শেখর বসু
- শৈবাল চক্রবর্তী
- শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
- শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জ্জী
- শ্রী ক্ষিতীশচন্দ্র কুশারী
- শ্রীধীরেন্দ্রলাল ধর
- ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
- সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
- সত্যজিৎ রায়
- সফিকুন নবী
- সমরেশ মজুমদার
- সরোজকুমার রায়চৌধুরী
- সুকুমার রায়
- সুখলতা রাও
- সুচিত্রা ভট্টাচার্য
- সুধীন্দ্রনাথ রাহা
- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
- সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
- সুবিনয় রায়চৌধুরী
- সুমথনাথ ঘোষ
- সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ
- সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
- সৈয়দ শামসুল হক
- সোনামণির ছড়া
- সৌরীন্দ্র মোহন মুখোপাধ্যায়
- স্বপনবুড়ো
- স্বাধীনতার ছড়া
- স্মৃতিচারণমূলক গল্প
- স্যার অর্থার কোনান ডয়েল
- হরিদাস সাহারায়
- হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
- হালিমা খাতুন
- হাসান আজিজুল হক
- হাসির গল্প
- হিতোপদেশের গল্প
- হিন্দু ধর্মের গল্প
- হিমানীশ গোস্বামী
- হুমায়ূন কবীর ঢালী
- হেমেন্দ্রকুমার রায়
- হ্যান্স অ্যান্ডারসন
